- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণে তামা গায়েব !

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক

জিয়াউল গনি সেলিম :

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণে তামা গায়েবের অভিযোগ উঠেছে। তিন শহীদ শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাস্কর্য নির্মাণে ১৪শ’ কেজি তামার বদলে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ৪৯২কেজি। এছাড়া, শৈল্পিক পরামর্শক কমিটি নিজেরাই শিল্পী হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে-এমন তথ্য উঠে এসেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। আছে প্রায় কোটি টাকা খরচে নানা অনিয়মের অভিযোগও।

রাবি’র শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২০১৪ সালের ২৯অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৪৫৫তম সিন্ডিকেট সভায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে এর নির্মাণকাজের জন্য ৮২লাখ ৬৫হাজার টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। এরমধ্যে ৭৬লাখ ৪৮হাজার টাকা ছাড় হয়েছে ব্যাংক থেকে। এই স্মৃতিফলকের সামনের অংশে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তিন শিক্ষক- ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড. হবিবুর রহমান ও মীর আব্দুল কাইয়ূমের ভাস্কর্য। এর বামপাশে নিচের দিকে বসানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাষ্কর্য। আর পেছনে রয়েছে ৫২’র ভাষাআন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত নানা সংগ্রামের চিত্র। ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর এই স্মৃতিফলকের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিন।

নির্মাণকাজের উদ্বোধনী ব্যানারের মডেলেও ছিল না বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য

এদিকে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণকাজের বিষয়টি। এরপর ফাইন্যান্স কমিটির সুপারিশে ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৪৭৩তম সিন্ডিকেট সভায় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বনাথ শিকদার।

তবে প্রায় দু’বছরের মাথায় চলতি বছরের গত ৮ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনটি ওঠে সিন্ডিকেট সভায়। প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও অভিযোগ সম্পর্কে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল সেলে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

এই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর রিলিফ ভাষ্কর্যটি স্থাপনে  ফাইন্যান্স কমিটির সুপারিশে সিন্ডিকেট সভায় পাস করা হয়। কিন্তু জাতির পিতা বুদ্ধিজীবী ছিলেন না এবং স্মৃতিফলকে যে স্থানে তাঁর ভাষ্কর্যটি সঠিকভাবে স্থাপন করা হয় নি।  সিন্ডিকেট সভায় রিলিফ ভাষ্কর্যের যে চারটি নকশা আলোচিত হয়, সেগুলোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধু ভাষ্কর্যটি অপসারণ করার সুপারিশ করা করেছে তদন্ত কমিটি।

স্মৃতিফলকের বামে নিচের অংশে বঙ্গবন্ধু রিলিফ ভাস্কর্য 

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এস্টিমেট অনুযায়ী ভাষ্কর্যগুলোতে ১৪শ’ কেজি তামার প্রয়োজন। কিন্তু শৈল্পিক পরামর্শ কমিটির আহ্বায়ক তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, ৮৫০ কেজি তামা কেনা হয়। এরমধ্যে ওয়েস্টেজ দেখিয়েছেন ২০-২৫শতাংশ। কাস্টিং করার সময় দুর্ঘটনাজনিত কারণে ১২০কেজি তামা নষ্ট হয়েছে।অন্যভাবে নষ্ট হয়েছে আরো ২৬কেজি।অর্থাৎ আসলে ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৪৯২কেজি। এছাড়া সিভিক/ শৈল্পিক কাজের জন্য টেম্পার্ড গ্লাসের এস্টিমেট ছিল তিন লাখ ৬০হাজার টাকা। টেম্পার্ড গ্লাসের কোনো তথ্য পায় নি তদন্ত কমিটি। কেনাকাটায় পিপিআর-এর কোনো শর্তই মানা হয় নি।

প্রকল্পে অর্থ খরচেও অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, অর্থ খরচের কোনো বিল/ভাউচার বা রেজুলেশন ও রেজিস্ট্রার দেখাতে পারে নি নির্মাণ কমিটির সদস্যরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এস্টিমেট অনুযায়ী কোনখাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়।

স্মৃতিফলকের ওপরের অংশে তিন শহীদ শিক্ষকের ভাস্কর্য

এই স্মৃতিফলক নির্মাণকাজের সাথে জড়িত ছিলেন- ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তারিকুল হাসান, উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল আলম, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক ঋতেন্দ্র কুমার শর্মা, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র সূতার এবং মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ফজলুল করিম ও একই বিভাগের অধ্যাপক একেএম ময়নুল ইসলাম।

তদন্ত কমিটির তথ্যমতে, স্মৃতিফলক নির্মাণকাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ও তার প্রতিনিধির কোনো অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা ছিল না। কমিটির সদস্যরা নিজেরাই সমস্ত কাজ করেছেন। এসব কারণে ভবিষ্যতে আর্থিক যে কোনো কাজ থেকে উল্লিখিত শিক্ষকদের বিরত রাখারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক

তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণ কমিটির প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে বলেন, এখানে কোনো ধরনেরই অনিয়ম বা দুর্নীতি হয় নি। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কমিটির কাছ থেকে কোনো হিসাবও নেয় নি। তাহলে তদন্ত কমিটি কীভাবে অনিয়ম বা দুর্নীতি খুঁজে পেলেন? এই কমিটির সদস্যরা আগের উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিনের অনুসারী হওয়ায় বর্তমান উপাচার্যপন্থীরা অহেতুক নাজেহাল করার চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য তার।  আর স্মৃতিফলকের শিল্প সমন্বয়ক অধ্যাপক ফজলুল করিম বলছেন, তদন্ত কমিটিতে কোনো এক্সপার্ট নেই। এই কমিটির কোনো সদস্যেরই শিল্প সম্পর্কে অ্যাকাডেমিক ও ব্যবহারিক কোনো জ্ঞান নেই। তাই তারা এমন উদ্ভট অভিযোগ  তুলেছেন। এখন পর্যন্ত স্মৃতিফলকের শিল্পীরা তাদের পারিশ্রমিকও পান নি বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর কার্যালয়ে গিয়েও সাক্ষাত পাওয়া যায় নি উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহানের। আর এ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হন নি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া।  তবে প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় আলোচিত হয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরামর্শ শাখায় পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন চাঁদা না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করলো যুবলীগ নেতা