শাড়ি নিয়ে লিখে সমালোচনার ঝড়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ


শাড়ি নিয়ে লেখায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।সমালোচনার পাশাপাশি তীব্র নিন্দিত হচ্ছেন এই জাতীয় অধ্যাপক। তার ‘পুরুষতান্ত্রিক’ দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করে হতাশ হয়েছেন নেটিজেনরা।

গত ৩০ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে শাড়ি শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ হয় অধ্যাপক আবু সায়ীদের।এর পর তার সমালোচনার ঝড় ওঠে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশেষ করে সাধারণ নারীরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছেন। নারী অঙ্গনের নেতৃস্থানীয়দের তোপের মুখেও পড়েছেন তিনি।

অশীতিপর এই অধ্যাপক ওই লেখা শুরু করেন এভাবে- ‘শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক।’তবে শালীন শব্দটিকে আছড়ে ফেলেছেন পরের লাইনেই।

তিনি লিখেছেন, ‘আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপা।’লেখার একপর্যায়ে তিনি বাঙালি নারীদের শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক ও আপত্তিকর মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ বাঙালি নারীর উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির বেশি না হওয়ায় শাড়ি পড়ার সৌন্দর্য তেমন বিকশিত হয় না।’এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের লম্বা গড়নের নারীরা শ্রেয়। এমনটিই লিখেছেন তিনি তার ওই লেখায়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এমন লেখার সমালোচনা করে সংবাদপত্রে তা প্রকাশের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অধিকারকর্মী খুশি কবির।তিনি বলেন, ‘এটা কী ছাপানোর যোগ্য ছিল? কীভাবে এ লেখাটা ছাপায়? ’

খুশি কবির বলেন, ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখাটিতে মধ্যযুগীয় পিতৃতান্ত্রিক-সামন্ততান্ত্রিক প্রতিফলক আছে। আসলে ওনার কাছ থেকে চাওয়ার কিছু নেই। আমাদের ওনার কাছ থেকে চাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে।’

তবে নারী ও সমাজ সম্পর্কে নারীদের মনোভাব জানতে অধ্যাপক আবু সায়ীদকে পরামর্শও দিয়েছেন খুশি কবির।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, ‘উনার মতো একজন ব্যক্তির কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে এমন লেখা প্রত্যাশিত করিনি। তিনি নারীকে পণ্য হিসেবে দেখেছেন।’

নাট্যকার-নির্দেশক মাসুম রেজা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখাটি পড়ে বিশেষ অনুশোচনায় ভুগছি যে কেন এটা পড়লাম।’তবে এ লেখা পড়ে পুরুষদের কুদৃষ্টিতে শাড়ি পরিহিত নারীর দিকে না তাকানোর অনুরোধ জানিয়ে একটি ফুটনোট আবু সায়ীদের লেখা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে লেখাটির জন্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কঠোর সমালোচনা করা ঠিক নয় মন্তব্য করে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘লেখাটার বেশ কয়েকটি শব্দচয়ন আমার কাছে খারাপ লেগেছে। তবে আমি এভাবে সমালোচনার পক্ষে নই।’

‘আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে’ কাজ করে যাওয়া সেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শাড়ি নিয়ে লেখার কড়া সমালোচনা করেছেন অপরাজিতা সংগীতা নামে একজন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন- ‘সকালটা শুরু হলো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ লেখাটি পড়ে। এই লেখাটির মাধ্যমে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ প্রমাণ করলেন ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান দিলেই ‘আলোকিত মানুষ’ হওয়া যায় না।’

শাড়িকে উপলক্ষ করে নারীর সৌন্দর্য নিয়ে অধ্যাপকের এমন রগরগে বর্ণনা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।চৈতালী খান নামে একজন লিখেছেন, ‘লেখকের সাথে একমত হতে পারলাম না। কেমন যেন একপেশে আর পুরুষতান্ত্রিক লাগল পুরো লেখাটা। আপনাদের চোখের শান্তি ছাড়া অন্য কোনো কাজ নাই বাঙালি মেয়েদের?’

হাসান মাহবুব লিখেছেন, ‘নারীদের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে আহত হলাম।’সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আবহমান কালজুড়ে বাঙালি নারীর প্রিয় সুন্দর সম্মান ও ব্যক্তিত্বের পোশাক হলো শাড়ি। শাড়ি আমার মা পরেছেন, আমার বোনেরা পরেন। শাড়ি আমাদের শিশুকন্যারাও পরে। শাড়িতে নারী আমার কাছে অনেক বেশি সম্মান ও শ্রদ্ধার।’

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার শাড়ি লেখাটির কিছু কিছু বর্ণনায় নারীকে পণ্যের শামিল করেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।আবু সায়ীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তার জীবনের পড়ন্ত বেলায় ভেতরে বাস করা যৌনবিকৃত পুরুষের চেহারাই উন্মোচিত হয়েছে।’

সমাজকর্মী জাকিরুল হক টিটন লিখেছেন, ‘ভালো ফল যেমন আঙুর, আপেল, বেদানাও পঁচে যায়, তেমনি মনে হয় প্রিয় স্যারেরও জায়গায় পচন ধরেছে। তা না হলে এমন মানুষ কেমনে এমন চটি সাহিত্য রচনা করতে পারে। নাকি বয়সের দোষ? ’

শামীম আরা শিউলি লিখেছেন, ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কেন শাড়ি নিয়ে লিখতে গেলেন জানি নাও এইটা কী ওনার বিষয়? এই বিষয়ে ওনার কী অভিজ্ঞতা আছে? উনি বরং লুঙ্গি নিয়ে লিখতে পারতেন ও’

শ্যামলী শীল লিখেছেন, ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ নিয়ে লেখাটি শুধু পুরুষতান্ত্রিক নয়, একই সাথে চরম বর্ণবাদী আর বডি শেমিংয়ে ভরা। পুরো লেখাজুড়ে তিনি বাঙালি নারী-পুরুষের গায়ের রঙ, উচ্চতা, শরীরের গড়নকে খুবই অবমাননাকরভাবে উপস্থাপন করেছেন।’

মারিয়া আজাদ লিখেছেন, ‘আবু সায়ীদ একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্বনামখ্যাত-সমাজসংস্কারক ব্যক্তিত্ব। তার কাছে মানুষ আশা করে অশ্লীলতাবিবর্জিত কথা ও আচরণ। তবে সায়ীদের এ লেখা যেন ক্লিনটন-মনিকাদের ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট। সায়ীদ তার লেখায় শাড়ির গুণগান এমনভাবে গেয়েছেন, যা শাড়ির বিপক্ষেই গেছে।’

এত আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওন লিখেছেন, ‘দিনশেষে কি ঠিক হইলো? শাড়ি কি আর পরব!’

প্রসঙ্গত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ টিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় এসে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখায় ২০০৫ সালে তাকে একুশে পদক দেয় সরকার।


শর্টলিংকঃ