Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

শান্তিনিকেতনে অনাবিল আনন্দে একদিন


এম এ আমিন রিংকু,  কলকাতা থেকে :

শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিমে আশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন।

পরে প্রায় ৪০ বছর পরে ১৯০১ সালে কবিগুরু শান্তিনিকেতন এ ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। ১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) কবিগুরুর উপস্থিতিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ১৯৫১ সালে ভারত সরকার কতৃক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেয়া হয়।

আমারা শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম শিক্ষা সফর ও রিসার্সের কাজে। ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের ব্যাবস্থাপনায় আইটেক স্কলারশিপ নিয়ে আমরা বাংলাদেশের ১৬ জন সাংবাদিক গিয়েছিলাম কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফ্লিম এন্ড টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। সেখান থেকেই সরকারী ব্যাবস্থাপনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শান্তিনকেতন।

এখনো অঙ্কুর যাহা তারি পথপানে, প্রত্যহ প্রভাতে রবি আশীর্বাদ আনে। প্রবেশ পথেই দেয়ালে চোখে পড়বে লাইনদুটি।কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতন ভ্রমনের মূল আকর্ষণ হলো রবীন্দ্রভবন প্রদর্শনশালা যেখানে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের আবাস উওরায়ন। বেশ কিছু ভবনের সমষ্টি হলো এই উওরায়ন।

আমাদের বাঙ্গালী সমাজের গর্ব ও অহংকার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৩ সালে পাওয়া নোবেল পদকটি এখানে রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আসল নোবেল পদকটি চুরি হয়ে যাওয়ার পর বর্তমানে নোবেল পদকের প্রতিলিপি রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রী যেমন : চীনামাটির প্লেট,নৌকা,কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার করা তুলি,ওষুধ,বাদ‍্যযন্ত্র সমূহ। এখানে গীতাঞ্জলি বইটির বিভিন্ন ভাষায় লেখা সংস্করণ রয়েছে।

শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলা, বকুলবীথি, আম্রকুঞ্জ, ঘণ্টাতলা, নতুন বাড়ি, কালোবাড়ি, সিংহ সদন, শান্তিনিকেতন ভবন, কাঁচের মন্দির ইত্যাদির সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য এক ভুবনে। শান্তিনিকেতনের হিমেল বাতাস দেয় অনাবিল এক প্রশান্তি, খোয়াই বনের ফাঁকফোকড় গলিয়ে রোদের ঝিকিমিকি। লাল মাটির রাস্তা ধরে যখন টুকটুক গাড়ি যাচ্ছে তখন মনে পড়ে – আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে।

বিশাল এলাকাজুড়ে গাছপালায় ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। একপাশে শান্তিনিকেতন অন্য পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহ ও হোস্টেল। চোখে পড়ল রামকিংকরের বিখ্যাত দুটি ভাস্কর্য। একটি হলো, দুই সাঁওতাল রমণী সন্তান নিয়ে কারখানায় কাজ করতে যাচ্ছেন। অপরটি সাঁওতাল শ্রমিক পরিবারের দেশান্তরে যাত্রা।

এখানে রয়েছে সংগীতভবন, কলাভবন, নাট্যঘর ও মালঞ্চ বাড়ি বর্তমানে যা বিশ্বভারতীর পাবলিকেশন অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কলাভবনের ছাত্রদের জন্য নির্মিত ছাত্রাবাসটির নাম ব্ল্যাক হাউজ। এই ছাত্রাবাসটির বাইরের দেয়ালে আলকাতরার আস্তরণ দেয়া হয়েছে। ছাত্রীদের জন্যও রয়েছে কয়েকটি ছাত্রীনিবাস। পাশে রয়েছে পাঠভবন নামক একটি বিল্ডিং, এখানে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের অভিনব ব্যাপার হলো, ২য় শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস সব সময় গাছতলায় হয়।

একটি করে বড় গাছের চারদিকে এক লাইন করে ইট দাঁড় করিয়ে দিয়ে এরিয়া করা আছে। একটি বোর্ড এককোণায় রাখা হয় পাঠদানের জন্য। ছাত্র-ছাত্রীরা মাটিতে বসে। আমি টুকটুক গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, বৃষ্টি হলে কিভাবে ক্লাস নেয়া হয়?’ সে জানালো, বৃষ্টির দিনে ক্লাস বন্ধ থাকে। পরে প্রতিদিন একটি করে বাড়তি ক্লাস নিয়ে তা পূরণ করা হয়। তবুও কখনও এসব ক্লাসরুমের মধ্যে হবে না। নবম ও দশম শ্রেণীর ক্লাসগুলো হয় পাঠভবনে। পাঠভবনের পাশেই রয়েছে সিংহসদন, যেখানে উঁচুতে বড় একটি ঘড়ি ও তার নিচে বড় একটি ঘণ্টা ঝোলানো আছে। এই ঘড়িটির মাধ্যমে ক্লাসের সময় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নিচে ঝুলন্ত দড়িটি টেনে ক্লাস পরিচালনার জন্য ঘণ্টা বাজানো হয়।

ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে বড় একটি বিল্ডিং, রবীন্দ্রভবন। বর্তমানে এই বিল্ডিংটিকে মিউজিয়াম করা হয়েছে। এই মিউজিয়ামে বিশ্বকবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র, তার স্বহস্তে আঁকা চিত্রকর্ম, গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রাপ্ত নোবেল প্রাইজটিও এখানে সংরক্ষিত আছে। কবি ও তার পরিবার যে জিপ গাড়িটি ব্যবহার করতেন তাও এখানে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন শান্তিনিকেতন থেকে যে বিশেষ ট্রেনে করে তাকে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার একটি মডেলও এখানে আছে।

যতদুর জানা যায়, কবিগুরু ছিলেন খুবই খেয়ালী মানুষ। তিনি একটি বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পছন্দ করতেন না। শান্তিনিকেতনের এই এলাকায় তার দশটি বাড়ি আছে। আর এই রবীন্দ্রভবন এলাকাতেই রয়েছে পাঁচটি বাড়ি। সেগুলোর রয়েছে বিভিন্ন নাম। যেমন-উদয়ন, কোর্নাক, শ্যামলী, পুনশ্চ এবং উদীচী। একেক ঋতুতে তিনি একেক বাড়িতে অবস্থান করতেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল শেষ হতে চলল। নীল আকাশে রক্তিম আভা, হেলে পড়েছে সূর্য। বিদায়ের সব আয়োজন পূর্ণ। শান্তিনিকেতন থেকে সকলে  কলকাতা রওনা হলাম। গাড়িতে হঠাৎ মনে পড়ল, মৃত্যুর কিছুদিন আগে কবি এই শান্তিনিকেতন সম্পর্কে লিখেছিলেন- যখন রব না আমি/মর্ত্যকায়ায়/তখন স্মরিতে যদি হয় মন/তবে তুমি এসো হেথা নিভূত ছায়ায়/যেথা এই চৈত্রের শালবন।’

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বা রবি ঠাকুরের জীবন নিয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য শান্তিনিকেতন অনেকটা তীর্থস্থানের মতো বলা চলে। শান্তিনিকেতনে একবার ঘুরে আসার পরও আরেকটু দেখার ইচ্ছে থেকেই যায়। এ যেন রবি ঠাকুরের ছোটগল্প-“শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”।

আরও পড়তে পারেন  দার্জিলিং ভ্রমণের আদ্যপান্ত


Exit mobile version