Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

শিক্ষকদের টিফিন ভাতা সাড়ে ৬ টাকা!


ইউএনভি ডেস্ক:

সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘টিফিন ভাতা’ বাবদ প্রতি মাসে সরকার থেকে ২০০ করে টাকা পান। বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ২৬ দিন কার্যদিবস থাকে। সে হিসাবে প্রতি শিক্ষক প্রতিদিন সাড়ে ৬ টাকার কিছু বেশি পান। শিক্ষকরা বলছেন, এ ভাতা নামমাত্র। সাড়ে ৬ টাকায় এক কাপ চায়ের চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। নামমাত্র এ ভাতা তাদের জন্য অসম্মানজনক।

তারা জানান, এক শিফটের বিদ্যালয়ে সকাল ৯টা থেকে সোয়া ৩টা এবং দুই শিফটের বিদ্যালয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা থাকতে হয় শিক্ষকদের। গত সপ্তাহে কুড়িগ্রামের একজন শিক্ষক তার টিফিন ভাতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে আবেদন করলে শিক্ষকদের টিফিন ভাতার অপ্রতুলতা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় বেতন স্কেল-২০০৯ থেকে প্রাথমিক শিক্ষকরা টিফিন ভাতা পেয়ে আসছেন। শুরুতে একজন শিক্ষক মাসিক ১০০ টাকা হারে টিফিন ভাতা পেতেন। পরে ২০১৪ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে এই ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হয় এবং সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য এই ভাতা মাসিক ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সংশ্নিষ্টরা জানান, শিক্ষকরা প্রতিদিন সাত ঘণ্টা বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন।

দুপুরে টিফিন বাবদ তারা মাথাপিছু ৬ টাকা ৬৬ পয়সা করে পান। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই একই ভাতা। সকাল ৯টায় স্কুল হওয়ায় অনেক শিক্ষক সকালে হাল্ক্কা নাশতা খেয়েই বিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দেন।শিক্ষকদের কর্মস্থল নিজ বাড়ি থেকে গড়ে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে। কারও কারও আরও বেশি দূরে। সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছুতে অনেকে আবার না খেয়েই বাড়ি থেকে রওনা দেন। পৌনে ৯টার মধ্যে তাদের উপস্থিত হতে হয় বিদ্যালয়ে।

আরোও পড়ুন:শিশু সায়মাকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ধর্ষক হারুনের ফাঁসি

রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আরা বীথি বলেন, ‘শিক্ষকদের টানা সাত ঘণ্টা ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে আধঘণ্টার মাত্র বিরতি। তখন টিফিন করা হয়। ১০ টাকার নিচে এক কাপ দুধ চা কোথাও পাওয়া যায় না। সকালে বাড়িতে রান্না শেষ না হওয়ায় অনেক শিক্ষকই খাবার নিয়ে আসতে পারেন না। বিকেলে সূর্য যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ে, তখন ক্ষুধায় শিক্ষকদের ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে আসে। বেশিরভাগই ছুটি শেষে বিকেলে বাড়িতে ফিরে দুপুরের খাবার খান।’ এই শিক্ষিকা বলেন, সরকার প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য মিড ডে মিল চালুর কথা ভাবছে। অথচ শিক্ষকদের কথা কেউ ভাবছে না। শিক্ষকরা অভুক্ত থাকলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

শিক্ষকরা জানান, দীর্ঘদিন থেকে প্রাথমিক শিক্ষকরা বেতন-ভাতার পাশাপাশি টিফিন ভাতা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তবে বিভিন্ন পেস্কেলে সরকার এ বিষয়টি যথাযথ মূল্যায়ন না করার কারণে শিক্ষকদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। সর্বশেষ গত ৫ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সরকারের বরাদ্দ করা টিফিন ভাতাকে হাস্যকর, অপর্যাপ্ত ও অসম্মানজনক আখ্যায়িত করে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর এই ভাতা প্রত্যাহারের আবেদন করেন কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার আবুল কাশেম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মনিবুল হক বসুনিয়া। যদিও তিনি তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার কারণে এই ভাতা প্রত্যাহার চেয়েছেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন।

উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে দেওয়া লিখিত আবেদনে মনিবুল হক বসুনিয়া বলেন, ‘…আমাকে প্রদেয় মাসিক টিফিনভাতা ২০০/-(দুইশত) টাকা, যা গড়ে প্রতিদিন ৬.৬৬ (ছয় টাকা ছেষট্টি পয়সা) হারে দেওয়া হয়, তা আমি ব্যক্তিগত কারণে প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি…।’

টিফিন ভাতা প্রত্যাহারের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজারহাট উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. সোলায়মান মিঞা বলেন, ‘একজন শিক্ষক ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তার টিফিন ভাতা প্রত্যাহারের জন্য আমার কাছে আবেদন করেছেন। আবেদনটি আমার অফিসেই আছে। দু-একদিনের মধ্যে আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তার আবেদনটি পাঠিয়ে দেব।’

‘একজন শিক্ষকের মাসিক টিফিন ভাতা ২০০ টাকা এটা অসম্মানজনক কিনা’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

টিফিন ভাতা প্রত্যাহারের আবেদন করলেন কেন জানতে চাইলে আবেদনকারী শিক্ষক মনিবুল হক বসুনিয়া বলেন, ‘মাসে ২০০ টাকা টিফিন ভাতা, যার অর্থ গড়ে প্রতিদিন ৬ দশমিক ৬৬ টাকা। আর যদি গড় কার্যদিবস ২৫ দিন ধরি তাহলে ৮ টাকা করে প্রতিদিন। বর্তমান বাজারে ৮ টাকায় দুপুরের খাবার বা নাশতা পাওয়ার চিন্তা করাও বোকামি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই চিন্তায়ই করেছেন, যা দুঃখজনক, হতাশাব্যঞ্জক, অসম্মানজনক, পাশাপাশি হাস্যকর বলে আমার মনে হয়েছে। যেহেতু ৮ টাকা দিয়ে দুপুরের খাবার তথা নাশতা পাওয়া অসম্ভব, সেহেতু টিফিন ভাতার নামে এই অসম্মানজনক প্রহসন থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই আমি আমার বেতন ভাতা থেকে টিফিন ভাতা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছি।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘একজন শিক্ষককে সকাল ৯টার আগেই বিদ্যালয়ে পৌঁছতে হয়। সে হিসেবে তাকে বাসা থেকে রওনা করতে হয়ে সকাল ৭টার মধ্যে। যেহেতু বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাকে বিদ্যালয়ে থাকতে হয়, তাই শিক্ষকদের টিফিন ভাতার পরিবর্তে দৈনিক লাঞ্চ ভাতা দেওয়ার দাবি জানাই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষকদের টিফিন ভাতা মাসিক ২০০ টাকা হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব কর্মচারীর টিফিন ভাতার পরিবর্তে দৈনিক ২০০ টাকা হারে লাঞ্চভাতা দেওয়া হয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, ‘একদিনের টিফিন হিসেবে সাড়ে ৬ টাকা অবশ্য খুবই কম, সত্যি। তবে সরকারকে প্রতিদিন সাড়ে তিন লাখের বেশি শিক্ষককে টিফিন ভাতা দিতে হয়। এটি বাড়াতে গেলে বড় বাজেট লাগবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আলোচনা করা হবে।’


Exit mobile version