সক্রিয়তা বেড়েছে প্রত্নসম্পদ চোরাকারবারিদের


ইউএনভি ডেস্ক:

হাজার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন বহন করে চলেছে বাংলার প্রাচীন জনপদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রগুলো। প্রাচীন জনগোষ্ঠী ও শাসকরা এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে গড়ে তুলেছে অসংখ্য ইমারত, নগর, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার, স্তূপ ও সমাধিসৌধ। সময়ের বিবর্তনে ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হয়েছে এর অধিকাংশই। যেগুলো টিকে রয়েছে, মহামূল্যবান সেসব প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। দীর্ঘদিন ধরেই এসব স্থান ও স্থাপনা থেকে প্রত্নসম্পদ চুরি ও তা বিদেশে পাচারে তত্পর রয়েছে চোরাকারবারিরা।

চলমান করোনা মহামারীতে প্রত্নসম্পদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা বাড়ায় আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্রগুলোর সক্রিয়তাও বেড়েছে। চুরি হচ্ছে একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর কিছু কিছু ধরাও পড়ছে। গত ছয় মাসে পাচারকারীদের কাছ থেকে শুধু কষ্টিপাথরের মূর্তিই উদ্ধার করা হয়েছে পাঁচটি।

বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া চোরাকারবারি চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা জানিয়েছেন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাচারকারী চক্রগুলো মূলত দুটি অংশে এ কার্যক্রম চালায়। এর একটি অংশ স্থানীয়, অন্যটি বিদেশী। স্থানীয় অংশটির কাজ হলো প্রাচীন বিভিন্ন শহরের মানচিত্র ধরে ওইসব এলাকা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি ও পাচার করা। বিদেশী অংশটি আন্তর্জাতিক বাজারে এসব প্রত্নসম্পদ বিক্রির কাজটি করে।

আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চুরি যাওয়া প্রত্নসম্পদের প্রথম গন্তব্য থাকে প্রতিবেশী কোনো একটি দেশ। সেখান থেকে এসব মহামূল্যবান সম্পদ নিয়ে যাওয়া হয় ইউরোপে। উন্নত দেশগুলোর ধনীরাই মূলত এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মূল ক্রেতা। চড়া মূল্যে এসব সম্পদ সংগ্রহ করে তারা। মহামারীসৃষ্ট নিরাপত্তা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসব চোরাকারবারি চক্র এখন আরো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে আশঙ্কা দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর।

সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, চলতি বছরে প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) সীমান্তপথে ভারতে পাচারকালে উদ্ধার হয়েছে চারটি কষ্টিপাথরের মূর্তি। এর মধ্যেই তিনটিই উদ্ধার হয়েছে জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে। কষ্টিপাথরের এসব মূর্তির বেশির ভাগই ছিল কোনো না কোনো প্রাচীন মন্দির থেকে চুরি করা। মাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্পসামগ্রীর সঙ্গে মিলিয়ে এসব নিদর্শন পাচারের চেষ্টা করা হচ্ছিল।

শুধু সীমান্ত নয়, চুরি যাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার হচ্ছে রাজধানী থেকেও। গত বুধবার রাতে বনানীর আমতলী এলাকার জলখাবার রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে দুর্লভ কষ্টিপাথরের হস্তনির্মিত একটি বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার করে র‍্যাব। কালো রঙের মূর্তিটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৫ ইঞ্চি এবং ওজন ১০ কেজি। এ সময় সেখান থেকে তিন সন্দেহভাজন চোরাকারবারিকে গ্রেফতার করা হয়।

র‍্যাব-১০-এর উপ-অধিনায়ক মেজর শাহরিয়ার হোসেন ওই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃত তিনজনই মূর্তি পাচারকারী। তারা ওই মূর্তি বিদেশে পাচারের জন্য নিজেদের কাছে রেখেছিল। কষ্টিপাথরের হস্তনির্মিত মূর্তি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করে আসছিল চক্রটি। দেশের মহামূল্যবান এসব সম্পদ রক্ষায় র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

র‍্যাবের তথ্য বলছে, গত এক যুগে শুধু ্‍র‍্যাবই প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণে অভিযান পরিচালনা করেছে তিন শতাধিক। এছাড়া গোয়েন্দাসহ পুলিশের অন্যান্য শাখা ও বিভাগও এ নিয়ে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে উদ্ধার হওয়া নিদর্শনগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই প্রাচীন মূর্তি বা মূর্তির ভগ্নাংশ। এছাড়া উদ্ধারকৃত নিদর্শনের তালিকায় প্রাচীন মুদ্রা, লিপিসহ অন্যান্য স্মারকও রয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত চোরাকারবারি চক্রের অনেক সদস্য গ্রেফতার হলেও পরে তাদের জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারো একই পেশায় ফিরে যাওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে।

র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরিতে বেশকিছু দেশী-বিদেশী চক্র সক্রিয় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চক্রগুলো পরস্পর যোগসাজশে কষ্টিপাথরের তৈরি মূর্তি ও মূল্যবান দ্রব্য অবৈধভাবে পাচার করে আসছে। তবে এর মধ্যে কিছু চক্র আছে, যারা পুরনো মুদ্রা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সামগ্রী অধিক মূল্যে বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধেও নজরদারি রয়েছে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্নতত্ত্বের নিরাপত্তা দিতে না পারার ব্যর্থতা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের। তাদের দুর্বল নজরদারির কারণে আন্তর্জাতিক চক্র স্থানীয় চক্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে এসব সম্পদ চুরি করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যরা দেশে এসে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে এসব নিদর্শন খুঁজে লক্ষ্যও নির্ধারণ করে দিয়ে যাচ্ছে। এসব নিদর্শন সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সূফী মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি অনেক পুরনো। সে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আমাদের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহ ছিল। কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার কারণে ধীরে ধীরে অনেক নিদর্শন চুরি হয়ে গিয়েছে। মহামূল্যবান এসব সম্পদ চুরি করার জন্য আন্তর্জাতিক চক্র সব সময়ই সুযোগ খুঁজতে থাকে। করোনাকালে দুর্বল নিরাপত্তার সুযোগে তারা আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু প্রত্নসম্পদ পাচারের সময় উদ্ধার হলেও বেশির ভাগই চলে যায়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য দ্রুত দেশের সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের তালিকা করা জরুরি।


শর্টলিংকঃ