সম্রাটের ক্যাডারের দখলে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি


যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ক্যাডার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি মুক্তিযোদ্ধার অসহায় পরিবারও। মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর কাজী মাজেদুর রহমানের মৃত্যুর পর তার কাকরাইলের গ্যারেজ পট্টির ৬ তলা ৩৬/২নং বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রায় পুরোটাই সম্রাটের ক্যাডাররা দখল নেয়।


রিয়াজ আহমেদ নামে পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ীর হয়ে তারা বাড়িটি দখল করে। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রিয়াজ নিলামে বাড়িটি কিনে নেন। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা উচ্চ আদালতে গেলে নিলামে বাড়ি ক্রয় স্থগিত করেন আদালত। তারপরও বাড়িটি ফিরে পায়নি মাজেদুরের পরিবার।

সম্রাটের ক্যাডার পল্টন থানা ছাত্রলীগের কাজী জাহিদের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন প্রতি মাসে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছে। এ নিয়ে সম্রাটের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবারটি। মঙ্গলবার যুগান্তরের কাছে এমনই অভিযোগ করেছেন মাজেদুরের স্ত্রী রোকসানা পারভীন ও ছেলে কাজী নিয়াজ রহমান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন সম্রাট একজন দখলবাজ, চাঁদাবাজ এবং টেন্ডারবাজ। অবৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে তিনি ক্যাডার বাহিনী পালতেন। এমনকি কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার পুরোটাই তিনি দখল করে রাজনৈতিক কার্যালয় বানিয়েছেন। এমনকি সেখানে তিনি প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাহর মতো হেরেমখানাও বানিয়েছেন।

কাকরাইলে মুক্তিযোদ্ধা মাজেদুরের বাড়ি দখলের বিষয়ে তার ছেলে কাজী নিয়াজ রহমান  বলেন, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বাড়িটি নিলামে তুলে সেটি দেউলিয়া আদালত থেকে কিনে নেন রিয়াজ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। তিনি বাড়িটি দখল করতে ছাত্রলীগ নেতা কাজী জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে জাহিদের নেতৃত্বে গত ২৫ জুন বাড়িটি দখল নেন।

প্রতিকারের জন্য তারা স্থানীয় কাউন্সিলর মোস্তবা জামান পপির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পপি বলেন, জাহিদ সম্রাটের লোক। নিয়াজ রহমান  বলেন, পরে আমরা সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। উচ্চ আদালতের মাধ্যমে নিলাম কার্যক্রমটি স্থগিত করা হয়। এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর মোস্তবা জামান পপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা  জানান, পল্টন এলাকার অধিকাংশ দখলবাজি এবং চাঁদাবাজি করে সম্রাটের ক্যাডার বাহিনী। পল্টনের ছাত্রলীগ নেতা কাজী জাহিদ সম্রাটের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা কাজী জাহিদ বলেন, আমাদের কাছে রিয়াজ আহমেদ (দখলদার) বাড়ির সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। তবে আমরা বাড়ি দখল করতে যাইনি।

সম্রাটের হেরেমখানায় ছিল ভিআইপিদের আনাগোনা : প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাহর মতোই হেরেমখানা রয়েছে গ্রেফতার যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের।

রাজধানীর কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের সপ্তম তলায় রাজনৈতিক কার্যালয়ের পাশে এই হেরেমখানায় প্রতি রাতে বসত ভিআইপিদের হাট। ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের বড় বড় নেতা সেখানে নিয়মিত যেতেন অতিথি হয়ে। সম্রাটের এই হেরেমখানায় রাতভর চলত মনোরঞ্জন। রুপালি জগতের অনেক তারকারও আনাগোনা ছিল সেখানে।

রোববার সম্রাটের ওই রাজনৈতিক কার্যালয়ে অভিযানে গিয়ে বিস্মিত হন র‌্যাব কর্মকর্তারা। ভবনজুড়ে আভিজাত্যের ছাপ। দু’বছর সম্রাট এ ভবনেই বসবাস করছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হেরেমখানায় নানা আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগ নেতা গ্রেফতার এনামুল হক আরমান। রুপালি জগতের তারকাদের সঙ্গে মূলত যোগাযোগ রাখতেন আরমানই। আর হেরেমখানায় ভিআইপিরা আসতেন আরমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেই। ভিআইপিদের চাহিদামতো মনোরঞ্জনের সব ব্যবস্থাই করতেন আরমান।

ভবনটিতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। সম্রাটের অনুমতি সাপেক্ষে কঠোর তল্লাশির পরই ভেতরে যাওয়া যেত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পুরো ভবনটিই সম্রাটের দখলে। ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় ছোট ছোট অফিস। সেখানে সম্রাট এবং সংগঠনের নেতাকর্মীদের ছবি পাশাপাশি সাজানো রয়েছে।

সাত তলা ভবনের ছাদের দক্ষিণ দিকে তৈরি করা হয়েছে একটি মনোরম বাগান। সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে কলাগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট ছোট গাছ। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি কৃত্রিম পাহাড়ি ঝরনা।

দেখে মনে হয়, শহর থেকে দূরে কোনো নির্জন পাহাড়ি এলাকা। উত্তর পাশের কক্ষটিই সম্রাটের হেরেমখানা। সেখানে বিলাসবহুল সব আসবাব ছাড়াও রয়েছে একাধিক ফ্রিজ এবং ওয়াশিং মেশিন। বেডরুম সংলগ্ন বাথরুমটিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, আরমান এক সময় বিদেশ থেকে লাগেজে আনা ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করতেন গুলিস্তানে। মিরপুরে মুদি দোকানি হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

২০১৩ সালে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতির পদ পেয়ে যান। এর পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন আরমান, নামেন সিনেমা ব্যবসায়। এই সূত্রে অনেক তারকার সঙ্গে যোগাযোগ তার। তাদেরই আরমান নিয়ে আসতেন সম্রাটের হেরেমখানায়।

প্রতি মাসে সম্রাট সিঙ্গাপুরে যেতেন ক্যাসিনো খেলতে : সূত্র জানায়, সম্রাট শুধু দেশেই বিলাসী জীবন কাটাতেন তা নয়, প্রতি মাসে অন্তত একবার সিঙ্গাপুর যেতেন। বান্ধবী নিয়ে প্রমোদতরীতে ভ্রমণ করতেন। দেশে উপার্জিত বিপুল অবৈধ অর্থ দিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনোয় জুয়ার আসর মাতাতেন। সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোয় প্রথম সারির জুয়াড়ি সম্রাট।

ভিআইপি জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে তাকে রিসিভ করে লিমুজিনে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোয় নিয়ে যাওয়া হতো। মাঝে মধ্যে আরমান ছাড়াও মোমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও খোরশেদ আলমও তার সফরসঙ্গী হতেন।


শর্টলিংকঃ