- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

সময়ের বিরুদ্ধ স্রোতে মুছে যাবে তব পদচিহ্ন?


প্রখর রোদ। পদ্মার বালুচরে একটা দুরন্ত কিশোর এলোমেলো হেঁটে বেড়াচ্ছে, কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর জলে। আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা প্রমত্তা পদ্মার বুকে এভাবেই কৈশোরের সেই দুরন্ত দিনগুলো কেটেছে পরবর্তীতে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের। ভবা নামের সেই দুরন্ত কিশোর ঋত্বিককে কখনো দেখা গেছে একমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন বাড়ির পাশের গাছতলায়। মায়ের উদর ভাগ করে নিয়ে যার সাথে ঢাকার একটি বাড়িতে পৃথিবীর বুকে আগমন, সেই জমজ বোন প্রতীতি দেবী ওরফে ভবীর সাথে কত হাসি-আনন্দের দিনই না কেটেছে রাজশাহী শহরের মিঞাপাড়ায় নিজের পৈতৃক বাড়িতে।

রাজশাহী শহরের মিঞাপাড়ায় ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি

পিতা সুরেশ কুমার ঘটক ছিলেন ব্রিটিশ আমলের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার চাকরিসূত্রেই নানা স্থান ঘুরে রাজশাহীতে নিজ ঠিকানা গড়ে নেওয়া। এরপর এলো উপমহাদেশের ইতিহাসে সেই বেদনাদায়ক বছর ১৯৪৭। দেশভাগের সেই ‘মেনে নেওয়া কিন্তু মনে না নেওয়া’র প্রাক্কালে অন্য অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের মতো ঋত্বিক ঘটকের পরিবারও দেশ ছেড়ে, প্রিয় রাজশাহী শহর ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়। নিজভূম ছেড়ে ‘পরবাসী’ হওয়ার বিষয়টি ভীষণভাবে আহত করে তরুণ ঋত্বিককে। ছেলেবেলা থেকে লেখালেখি, নাট্যচর্চা আর সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহী ঋত্বিক বাকি জীবন আর এই বেদনার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাননি। তাঁর প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রে এই দেশভাগের যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে।

কিংবদন্তি চলচিত্রকার ঋত্বিক ঘটক

রাজশাহীতে এই বাড়িতে থাকার সময়ই ঋত্বিক ঘটক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ এবং বাড়ির পাশের রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে করেছেন নাট্যচর্চা। তখনকার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে রাজশাহীতে এনেছেন নাটকের অনুষ্ঠানে। ঋত্বিক ঘটক এই সময় রাজশাহীতে ‘অভিধারা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। রাজশাহীর কল্পনা সিনেমা হলে প্রদর্শিত (পরবর্তীতে উৎসব হল, যা বর্তমানে বিলুপ্ত) ‘ভাবীকাল’ নামে একটি চলচ্চিত্রের ব্যানারও এঁকেছেন বলে জানা যায়। তারুণ্যেই রাজশাহীর তৎকালীন সাংস্কৃতিক জগতে সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি।

কিংবদন্তি চলচিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সাড়া জাগানো কিছু চলচিত্র

এরপর নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশের শহর কলকাতায় গিয়ে ঋত্বিক নাটক, রাজনীতির পর পা রেখেছেন সিনেমার জগতে। দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তু মানুষ, শোষিত, নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের পক্ষে কথা বলতে ঋত্বিক যখন যে মাধ্যম পছন্দ করেছেন তাই বেছে নিয়েছেন। সিনেমার জগতে আসা প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, মানুষের কথা বলার জন্য এক সময় তাঁর মনে হয়েছিল থিয়েটারের চেয়ে সিনেমা অনেক বেশি শক্তিশালী মাধ্যম। তাই তিনি থিয়েটার ছেড়ে সিনেমায় এসেছেন। আবার সমাজের অন্যায়-অসঙ্গতি তুলে ধরার জন্য যদি কখনো এর চেয়েও ভাল মাধ্যম তিনি পান তখন সিনেমা ছেড়ে সেটাই ব্যবহার করবেন।

ঋত্বিক কবিতা-গল্প লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, নাটক প্রযোজনাও করেছেন। এরপর তিনি ১৯৫২ সালে নাগরিক নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন, যা তাঁর জীবদ্দশায় আর মুক্তি পায়নি। এরপর একে একে অযান্ত্রিক, মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, তিতাস একটি নদীর নাম প্রভৃতি যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তা শুধু বাংলা চলচ্চিত্রেই নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেরই গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বাংলা চলচ্চিত্রে যে তিনজনকে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ধরা হয়ে থাকে, ঋত্বিক ঘটক তাঁদের একজন বাকি দুজন হলেন সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন।

ঋত্বিক ঘটকের সাড়া জাগানো কিছু চলচিত্রের স্থিরচিত্র

দেশভাগের পরে হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী যেসব পরিবার এ দেশ ছেড়ে চলে যায় পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের জমিকে ‘এনিমি প্রোপার্টি’ বা ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করেন। রাজশাহীতে মিঞাপাড়া পাবলিক লাইব্রেরির পাশে ঋত্বিকদের ফেলে যাওয়া সেই জমিটিও একইভাবে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেখানে এখন রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালে সেখানে টিনের ছাপড়া তুলে কলেজের যাত্রা শুরু। আশির দশকের শেষের দিকে এরশাদ সরকারের সময় তারা জমিটি লিজ নেয় (যদিও তাদের কারো কারো বক্তব্য জমিটি তারা কিনে নিয়েছেন)। আর ২০০৬ সালের দিকে সেখানে একটি অংশে বর্তমানের দোতলা ভবন নির্মাণ করেন।

রাজশাহীতে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি পরিদর্শন করেন

ঋত্বিকের এই পৈতৃক ভিটার ৩৪ শতক জমির অর্ধেক অংশ জুড়ে এখন এই দোতলা ভবনে হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। ভিটার এই অংশে ঋত্বিকদের পরিবারের কোনো ঘরদোর ছিল না বলে কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি। এর বাকি অংশে লোনাধরা হলুদ রঙ করা দেয়ালের যে কয়েকটি কক্ষ এখনো রয়েছে সেগুলো আমাদের রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মতে ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের থাকার ঘর, বৈঠকখানা ছিল। এই ঘরগুলোও কলেজ কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের বহির্বিভাগ, কমনরুম হিসেবে ব্যবহার করছে। এখানে একটি কুয়া ছিল তাদের, যা এখন খুঁজে পাওয়াই ভার।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ

রাজশাহীর প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কবি অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক স্মরণ করেন, এই বাড়িতে ঋত্বিকের বড় ভাই মনীশ ঘটকের মেয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী আশির দশকে এসেছেন। অধ্যাপক প্রামাণিক তাঁকে নিয়ে এখনকার এই ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবীও ছেলেবেলায় এই বাড়িতে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন। তিনি ঘরগুলো দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ঋত্বিকের জমজ বোন প্রতীতি দেবী আজো বেঁচে আছেন। তিনি এখন ঢাকায় থাকেন।

গত ৪ নভেম্বর ৯৪ বছরে পা দেওয়া ঋত্বিকের এই সহোদরাও রাজশাহীতে এসে তাঁদের এই বাড়ির এই ঘরগুলো দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছেন। প্রতীতি দেবীর মেয়ে ও ঋত্বিকের ভাগ্নি, বর্তমান সরকারের আমলে সংরিক্ষত নারী আসনের সাবেক এমপি আরমা দত্তও এই বাড়ি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন এই ভিটায় এসে।

রাজশাহীতে সাংস্কৃতিক জগতের কোনো গুণি ব্যক্তি বেড়াতে এলে এই ভিটাতে একবারের জন্যে হলেও পা রাখেন ঋত্বিকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি দেখে তাঁরা কিংবদন্তি এই চলচ্চিত্রকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দেশের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ অনেকেই, দেশের বাইরে বর্তমানে জীবিত বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সবচাইতে সমাদৃত ভারতের বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বর্তমান মন্ত্রী ও চলচ্চিত্রাভিনেতা ব্রাত্য বসু, ঋত্বিকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান, অভিনেতা প্রবীর মিত্রসহ অনেকেই এই ভিটাতে এসেছেন।

বাড়ির একাংশ ভেঙ্গে সাইকেল গ্যারাজ বানানো হচ্ছিল

সম্প্রতি কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার এনায়েত করিম বাবুলকে নিয়ে রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা সেই ভিটায় গিয়ে দেখতে পান, কলেজ কর্তৃপক্ষ ভিটার একটি দেয়াল ও একটি ঘর ভেঙে ফেলছেন। অথচ এই কিছুদিন আগেও (৪ নভেম্বর) ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি যখন সেই ভিটায় ‘৮ম ঋত্বিক সম্মাননা প্রদান ও চলচ্চিত্র উৎসব’ আয়োজন করে তখনও সেখানে সেই দেয়াল ও ঘরটি ছিল। এখন সেটি ভেঙে সেখানে তারা কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণ করবেন জানতে পেরে রাজশাহীর চলচ্চিত্র সংসদগুলো ও অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ঋত্বিকের স্মৃতিবিজড়িত এই পৈতৃক ভিটা রক্ষায় রাজশাহীতে সক্রিয় ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ ও বরেন্দ্র চলচ্চিত্র সংসদের পক্ষ থেকে গত ২৪ ডিসেম্বর নগরীতে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়। এতে রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষ বিপুল সাড়া দেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচিত্রকর্মীদের মনববন্ধন

আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে শুরু থেকেই এই আন্দোলনে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইতিমধ্যেই রাজশাহীর জেলা প্রশাসক, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন স্থানীয় সহকারী কমিশনার (ভূমি)-কে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত চলছে।

আমাদের অগ্রজ চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের মাধ্যমে আমরা সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথেও যোগাযোগ করেছি। আমাদের দাবি, এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণ করে এখানে ঋত্বিকের নামে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হোক। এ জন্য হোমিওপ্যাথিক কলেজকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুরো ভিটায় ঋত্বিকের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সেখানে চলচ্চিত্র কেন্দ্রের পাশাপাশি ঋত্বিক স্মৃতি জাদুঘরও গড়ে তোলা যেতে পারে।

সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে চলচিত্রকর্মী্দের মানব বন্ধন

আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষ যেভাবে এখানে ঋত্বিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকার কথা অস্বীকার করছেন তাতে আমরা শঙ্কিত, এখানে কলেজটি বহাল থাকলে ভবিষ্যতে ঋত্বিকের স্মৃতিবিজড়িত যেসব কক্ষগুলো এখনো টিকে আছে তাও ভেঙে ফেলে সেখানে বহুতল ভবন তোলা হবে যা মোটেও কাম্য নয়। কলেজের একজন শিক্ষক এটা প্রকাশ্যেই স্বীকার করছেন। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, অবশিষ্ট কক্ষগুলোর স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন ও বরাদ্দ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু মামলার কারণে আটকে আছে। মামলা না থাকলে সেগুলোও এতোদিনে ভেঙে ফেলা হতো বলে বেশ গর্বের সঙ্গেই তিনি জানালেন।

গুণি ব্যক্তিদের বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী গুণি ব্যক্তিদের স্মৃতিচিহ্নকে মুছে ফেলার যে বিরুদ্ধ সময়ে আমরা প্রতিবাদমুখর হয়েছি তাতে আমাদের একটাই প্রত্যাশা, পদ্মাপাড়ে ঋত্বিকের বাড়ি রক্ষা করা হোক, বিরুদ্ধ সময়ের স্রোতে যেন তাঁর পদচিহ্ন মুছে না যায়।

ড. সাজ্জাদ বকুল
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এবং সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ।
ফোন: ০১৭১৬৬৭২৮৮৪
ইমেইল: sazzadbokulru@gmail.com