সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিদ্বেষের ডামাডোলে অপরাজনৈতিক পায়তারা


সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিদ্বেষের ডামাডোলে অপরাজনৈতিক পায়তার

ক্যান্সারের ভাইরাসও বোধয় কেমোথেরাপির মাধ্যমে স্বমূলে ঝেড়ে ফেলা যায় কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাস ঝেড়ে ফেলা যায়না।এই ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ অত্যান্ত সুকৌশলে আমাদের মননে মগজে বপন করা হয়েছিল তা আজ বিশাল বিষবৃক্ষে রূপ নিয়ে স্বগৌরবে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নিজ অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে(ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান) হিন্দু মুসলিম অসহিষ্ণুতার পেছনে একটা বড়  ইতিহাস আছে যা আমরা জানাস্বত্তেও অনেক সময় আমলে আনিনা।নিকট অতীতের ইতিহাসের পাতায় ঝেঁকে দেখলেই জানা যায়… এই উপমহাদেশের আমরা সকলেই কিন্তু ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং নিম্ন বর্গের হিন্দু থেকে ধর্ম ত্যাগ করে আসা।ব্রাহ্মণ হিন্দু সমাজের বর্ণবানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজেদের জান বাঁচাতে আমাদের নমশূদ্র হিন্দু পূর্বপুরুষরাই ইসলামের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে ছিলেন।

যে ক্ষোভ  আর ঘৃণা নিয়ে ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন,সেক্ষত তো সহজে মিটবার নয়।তাই আজো প্রজন্ম থেকে  প্রজন্মে আমরাও বয়ে বেড়াচ্ছি সেই ক্ষতের বোঝা।এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক একি ঘটনা আমরা  আরব অঞ্চলে দেখতে পাই।ইহুদী এবং নাসারা(যীশুর গ্রামের নাম ছিল নাসারাত আর তাদের  অধিবাসীদের বলা হত নাসারা অর্থাৎ খৃষ্টান)সম্প্রদায়ের অনেক নিুবর্গের অত্যাচারিত  মানুষ  ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের প্রতি মুসলিমদের বিদ্বেষ আজো  দেখা যায়।

বিশ্বময় সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার পটচিত্র প্রায় একই।এবার মূল কথায় আসি আজ কথা বলবো ভারতের তুমুল নিন্দিত ঘজঈ এবং ঈঅই নিয়ে।অনেকেই  প্রশ্ন তুলতে পারেন ভারত প্রসঙ্গ কেনো ? তাই আগেই বলে রাখি এটা ভারত কিংবা মুসলিমদের একার সমস্যা নয়।এরসাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশ,ভূরাজনীতি এবং মানবিক মূল্যবোধের যায়গাটিও।যে দেশেই হোক যে সমাজেই হোক অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারাণ করবার অধিকার একজন বামপন্থী প্রগতিবাদী হিসেবে আমার আছে বলে আমি মনে করি।

আর হ্যাঁ কাঁটাতার কিংবা বর্ডার থাকে  মাটির উপর,মাটির ভেতর কোন জোড় নেই-এক এবং অভিন্ন। বামপন্থী প্রগতিবাদী প্রসঙ্গে বলার আরো একটি কারণ হল গত ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর আমি ছিলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে তাই  NRC CAB বিরোধী আন্দোলনটা খানিকটা হলেও নিজ চোখে দেখবার এবং সাধারণ মানুষের মনের  ইচ্ছাটা জানবার সুযোগ হয়েছে যা আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই।

সোজা কথায় বলতে হলে ১৯৭১ সালের পর থেকে  অবৈধভাবে ভারতে অবস্থানরত অভারতীয়দের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া।এখন প্রশ্ন হল এনিয়ে আন্দোলন
হবার কারণ কি ?।প্রথম কারণটি হল এই বিল ভারতের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।সংবিধান  অনুযায়ী ভারত একটি সেকুলার রাষ্ট্র আর এই ঈঅই বিলটি একটি সাম্প্রদায়িক বিল।কারণ NRC  বিলে বলা হয়েছে পার্শবর্তী রাষ্ট্র গুলো যেমন বাংলাদেশ,পাকিস্তান,আবগানস্তান,মায়ানমার থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হয়ে কেউ যদি ভারতে আশ্রয় নিতে চায় তবে কেবলমাত্র মুসলিম বাদে অন্য সব সম্প্রদায় তা নিতে পারবে।

মুসলিমদের বেলায় এই আইন কেনো তা অন্তত মোদী-অমিত সাহাদের প্রশ্ন  করবার কোন মানে হয়না।উগ্রসাম্প্রদায়িক এবং একাধিক দাঙ্গার প্রধান পৃষ্টপোষকদের কাছে এরচেয়ে কিবা আশা করা যায়।মোদী-অমিত সাহা এখানে ধর্মের কার্ড খেললেও ভেতরে রাজনীতির খেলা  আছে,ধর্মকে জাস্ট মানুষকে বিভাজিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।অনেক গোঁড়া হিন্ধুত্ববাদী মনে করেন মোদী-অমিত সাহারা ভারতকে প্রকৃত হিন্দুস্তান বানাবেন কিন্তু বাস্তবতা মোটেও তেমনটা
নয়।

যদিও ইতিমধ্যে গোমাতা নিয়ে মঞ্চে অনুষ্ঠান করে কিংবা বাবরি মসজিদ রাম মন্দির ইস্যুতে হিন্দুস্তানের স্বপ্ন বাস্তবায়নকর্তা রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তবুও একবার ভেবে দেখুন তো  ভারতকে পুরোপুরি মুসলিম শূন্য করা এবং শতভাগ হিন্দুদের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌও  সম্ভব…না সম্ভব না।অন্তত NRC CAB দিয়ে তো নয়ই যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আসাম।আসামে ঘজঈ তে বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে প্রায় ১১ লাখই হিন্দু ধর্মাবলম্বি কাজেই এটা ভাববার কোনই সুযোগ
নেই যে হিন্দুরা ভারতে নিরাপদ।

হিন্দুস্তানের স্বপ্ন অবাস্তব তার আর একটি বড় কারণ,সাধারণ মানুষ তেমন ভারত চায় না।সারা  ভারতব্যাপী NRC CAB  বিরোধী আন্দোলন সে কথা জানিয়ে দিয়েছে।ধর্ম বর্ণ জাতি গোষ্ঠী সবাই  মিলিত হয়ে ঘজঈ ঈঅই কে কালা কানুন আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নেমেছে।ধর্মগুরুদের ফতোয়ায় কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের উস্কানিতে হিন্দু মুসলিম লড়ে পড়ে ঠিকি তবে সবাই মিলেই ভারতে থাকতে চায়।যদি তা না হতো তবে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া হিন্দুস্তানে মুসলিম আর পাকস্তানে হিন্দু থাকতো  না,৪৭ এই ধর্মের ভিত্তিতে ঘর বাধতো।এই উপমহাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনার সবচেয়ে বড় নিয়ামক  অশিক্ষা।শিক্ষিত মানুষ ধর্ম নিয়ে লড়ে পড়েনা,অন্য ধর্মের মানুষের উপর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেনা।

সাধারণ  মানুষ শিক্ষিত হতে চায়-দুবেলা খেয়ে পরে বাঁচতে চায়-সুন্দর জীবন চায় আর এসব থেকে দূরে সরাতেই অমিত মোদীদের এই পাঁয়তারা।কারণ খুব ¯পষ্ট এসব চাহিদা মেটাবার কথা দিয়ে  ভোটভিক্ষা করে তারা মসনদে বসেছেন।ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটজনক,বাজারে  নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য চড়া, নেই  কর্মসংস্থান,রাজ্যগুলো বিশেষকরে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী  রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকায় কেন্দ্র থেকে নেই তেমনকোন উন্নয়ন।এমন অবস্থায় শাক দিয়ে মাছ
ঢাকতে অমিত-মোদির এই নয়া কৌশল এমনটা মনে করেন সাধারণ জনগণ।সাধারণ মানুষের সাথে  আমি কথা বলে দেখেছি কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া ধর্মীয় বিদ্বেষ তাদের মধ্যে খুব একটা নেই,তারা সকল  ধর্ম সকল জাতির সকল ভাষার মিলিত ভারত চায়।কিন্তু অমিত-মোদি NRC CAB এর নামে  সাম্প্রদায়িক জাতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পানি ঘোলা করছে।

কোথাও ধর্মের নামে হিন্দু মুসলিম লড়ে পড়ছে  কোথাওবা পিটিয়ে মারা হচ্ছে বাঙালিদের।নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে অপারগ একটি  সরকার শেষমেশ সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার খেলায় মেতেছে।তবে আমার  বিশ্বাস ভারতের জনগণ তা কখনোই মেনে নেবেনা।  আমার কাছে মনে হয় গোটা পশ্চিম বঙ্গে ঘজঈ ঈঅই চালুর আর একটি বড় কারণ বিজেপির  রাজনীতি।পার্লামেন্টে শক্তিশালী হলেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থা কোন ঠাঁসা।ঘরে বাইরে মমতা
মোদির যে দা কুমড়ো স¤পর্ক তা সবারই জানা।হিন্দুত্ববাদের কার্ড খেলে সাম্প্রদায়িক জাতি দ্বন্দ  লাগিয়ে বিজেপি ভোট পলিটিক্সে যে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে।এটা ডিভাইড এন্ড রুলের পুরোনো কৌশল নতুন কিছু নয়।

এবার আশি আমাদেরদেশ প্রসঙ্গে,ইচ্ছা না থাকলেও ঘজঈ ঈঅই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ  জড়িয়ে গেছে।আসাম কিংবা পশ্চিমবঙ্গে অনেক বাংলাদেশী অবৈধ ভাবে আছে একথা সত্য কিন্তু  বাদপড়া ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশী প্রমাণের একটি বিশাল ষড়যন্ত্র চলছে।সেই সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে এও প্রামানের চেষ্টা হচ্ছে যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে জাতি সম্প্রদায় কিংবা  গোষ্ঠী দ্বন্দ নেই।কিছুসংখ্যক সংখ্যালঘুদের উপর নিশ্চয় নির্যাতন হয় তবে তা ধর্মীয় কিংবা জাতিগত  বিদ্বেষ এর উপর ভিত্তি করে নয়।তার পিছে রয়েছে রাজনৈতিক এবং ভোগবাদী লালসা,একথা আমি অনেক লেখায় বিস্তারিত লিখেছি।প্রিয়া সাহারা অবশ্য এই অভিযোগ সত্য প্রমাণ করতে অনেক ঘাম  ঝরিয়েছে তবে বিশেষ লাভ হয়নি।মোদির টাকা খেয়ে প্রিয়া সাহা মার্কিন মুলুকে নালিশ করে বেড়িয়েছে এমন সম্ভবনার কথা খোদ ভারতের একাধিক মানুষ আমাকে বলেছে।

বিগত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার,সকল ধর্ম জাতি গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল  অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চিন্তা ধারায় বিশ্বাসী হওয়ায় নিন্দুকদের কাছে তো তারা হিন্দুদের  সরকার বলেই পরিচিত তাহলে হিন্দুদের এই সময় তাড়িয়ে বিদেয় করছে কারা ?।বিএনপি জামাত আমলে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয়েছে ঠিকি তবে হিন্দুরা একাই ভুক্তভুগি ছিল কি…বিরোধী  মতাদর্শী প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষদের উপরও অত্যাচার হয়েছে।

সেসময়ের অত্যাচারে  নিশ্চয় হিন্দুদের দেশ ছাড়ে পালাতে বাধ্য হতে হয়নি অনেকে নানান সমীকরণে যাওয়াটা লাভজনক  ভেবেছিলেন বিধায় গিয়ে থাকতে পারেন।যদি ৭১ সালের কথা বলা হয় তবে সে অত্যাচার তো আমরা  করিনি তার দায় আমরা নেব কেনো।

বাংলাদেশ সরকার এসব ভ্রান্ত অভিযোগের তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছে এবং ভারতে সরকারী সফর বাতিল করেছে।বাংলাদেশ সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে,অভিনন্দন রইল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি।ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে সরকার বিপাকে পড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবার কথা দিয়ে অমিত মোদিরা এবার নাগরিকত্ব  কেড়ে নেওয়া ভারতীয়দের বাংলাদেশী আখ্যা দিয়ে আমাদের ঘাড়ে ঝুলাতে চাচ্ছে।এ পরিস্থিতি বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সাথে মোকাবেলা করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই অমিত মোদির এই বিভাজনের রাজনীতি ভারতের জনগণকে মিলিত ভাবেই  মোকাবেলা করতে হবে।হিন্দু মুসলিম বাঙ্গালি অবাঙ্গালি প্রতিটি জাতি প্রতিটি ধর্মের মানুষের এ লড়াই  তা বুঝতে হবে।ভারত আজ মুসলিম দের জন্য যতখানি অরক্ষিত হয়ে উঠেছে ঠিক ততখানিই  অরক্ষিত হয়ে উঠেছে হিন্দুদের জন্যও,যতখানি বাঙ্গালির জন্য ঠিক ততখানিই অবাঙ্গালির  জন্য।হিন্দুত্ববাদের মুলা দেখিয়ে অমিত মোদিরা যে স্বপ্ন দেখাচ্ছে তা ভোট রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই
নয়।

NRC CAB বিরোধী আন্দোলনে ভারতীয় জনতার বিজয় হবে এবং হিন্দুস্থান নয় সকল ধর্ম সকল  জাতি সকল ভাষার মিশ্রনে প্রকৃত সেকুলার ভারত প্রতিষ্ঠিত হবে এই কামনা করি। NRC CAB বিরোধী আন্দোলনে সংহতি,জনতার বিজয় কাম্য।

লেখকঃতামিম শিরাজী,
সাবেক সাধসম্পাসম্পাদক,বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।


শর্টলিংকঃ