সাসপেন্ডের পরই হামলার ছক কষে রবিউল


ইউএনভি ডেস্ক:

পাঁচ মাস আগে থেকেই দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) কর্মচারী রবিউল ইসলাম। গত মার্চের প্রথম দিকে ইউএনওর ব্যাগ থেকে ১৬ হাজার টাকা চুরি করে ধরা খাওয়ার পরই মাথায় ওই চিন্তা আসে তার। রবিউল ইউএনওর বাসায় মালি হিসেবে কাজ করতেন। মার্চে তিনি সাসপেন্ড হওয়ার পরপরই ইউএনওর ওপর হামলার ছক কষেন।

মাস দুয়েক আগে হাতুড়িও কিনে রেখেছিলেন তিনি। এ তথ্য সামনে আসায় এটা পরিস্কার- পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ইউএনওর ওপর নৃশংস ওই হামলার ঘটনা ঘটে। ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ছয় দিনের রিমান্ডে রয়েছেন রবিউল। রিমান্ডে দিনাজপুর জেলা ডিবি পুলিশের কাছে এসব তথ্য জানান তিনি। পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল সমকালকে এসব তথ্য জানায়।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ঘটনার দিন বিকেল ৪টার দিকে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিজোড়া গ্রামের ধামাহার ভিমরুলপাড়া থেকে ঘোড়াঘাটে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হন রবিউল। পথে দিনাজপুর সদরের ষষ্ঠিতলায় মোহাম্মদ হেয়ার কাটিং নামে একটি দোকানে নিজের সাইকেল রাখতে যান। তবে ওই দোকানি তার সাইকেল রাখতে রাজি হননি।

এরপর একটি গ্যারেজে সাইকেল রাখার চেষ্টা করেন তিনি। ওই সাইকেল গ্যারেজের মালিক মুরাদ রবিউলকে জানান, এর বিনিময়ে তাকে টাকা দিতে হবে। টাকার বিনিময়ে গ্যারেজে সাইকেল রাখতে রাজি হন তিনি। এরই মধ্যে আদালতে সাক্ষী হিসেবে সাইকেলের গ্যারেজ ও সেলুন মালিকের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গ্যারেজে সাইকেল রেখে তৃপ্তি পরিবহনের একটি বাসে ঘোড়াঘাটের দিকে রওনা হন রবিউল। এরপর তার অপারেশন শেষে হানিফ পরিবহনের বাসে আবার নিজ বাড়িতে ফেরত আসেন। পথিমধ্যে একটি জায়গায় খিচুড়ি খেয়েছেন। আর যে পোশাক পরিহিত অবস্থায় ইউএনওর বাসায় ঢুকেছিলেন তা বিরামপুরে পুড়িয়ে দেন তিনি।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ইউএনও ও তার বাবার ওপর হামলার পর ওই বাসা থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি করেন রবিউল। ইউএনওর ব্যাগ থেকে ওই টাকা চুরি করেছিলেন। এরপর ওই টাকা বিরলের জনৈক জুয়াড়ি খোকনের হাতে দেন। এরই মধ্যে তার কাছে থেকে ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা জব্দ করেছে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, রবিউল অনেক শক্ত মানসিকতার। এত বড় ঘটনা ঘটানোর পরও স্বাভাবিকভাবে সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে মোটামুটি নিশ্চিত- এ ঘটনার সঙ্গে রবিউল একাই জড়িত। তার পরও ইউএনওর বাসার প্রহরী নাদিম হোসেন পলাশের ভূমিকা আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ একসময় পলাশের সঙ্গে রবিউলের সখ্য ছিল।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রবিউলকে এ ঘটনায় শনাক্ত করা তাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ র‌্যাবের হাতে সন্দেহভাজন হিসেবে আসাদুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর চুরির গল্প ফাঁদেন তিনি। আসাদুলকে সাত দিনের রিমান্ডে নিলেও চতুর্থ দিন পর্যন্ত তিনি দাবি করতে থাকেন- এ ঘটনার সঙ্গে তিনি একাই জড়িত। তবে তার বক্তব্যের সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজসহ অনেক আলামতের মিল পাওয়া যাচ্ছিল না।

রিমান্ডের পঞ্চম দিনে আসাদুল জানান, তিনি এই চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এরপর আসাদুলের ওপর থেকে নজর সরিয়ে ভিন্নমুখী তদন্ত শুরু হয়। ইউএনওর সঙ্গে কার কার দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল তার খোঁজ নিতে থাকে পুলিশ। যার যার ব্যাপারে সন্দেহ করা হচ্ছিল তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদও তদন্তের ব্যাপারে সার্বিক নির্দেশনা দেন। মাঠ পর্যায়ের তদন্তকারীদের সঙ্গে একজন বিশেষ কর্মকর্তাকে যুক্ত করেন পুলিশ প্রধান।

ইউএনওর সঙ্গে মতবিরোধ বা কোনো কারণে তার ওপর ক্ষিপ্ত হতে পারেন- এমন একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো ক্লু মিলছিল না। এরপর পুলিশের সামনে আসে সাসপেন্ড হওয়া কর্মচারী রবিউল ইসলামের নাম। পরে তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্তে দেখা যায়- একটি সন্দেহভাজন মোবাইল নম্বর ব্যবহারকারী দিনাজপুরের বিরল থেকে ঘোড়াঘাট গিয়েছেন।

ওই নম্বরটি রবিউলের কিনা এটি নিশ্চিত হতে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রবিউলের স্ত্রী বারবার বলছিলেন, তার স্বামী ওই ঘটনায় জড়িত নন। মোবাইল নম্বরটির ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট তথ্য না দেওয়ায় পুলিশের সন্দেহ জোরালো হয়। নানা তথ্য-উপাত্ত হাতে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রবিউল স্বীকার করেন- তিনি একাই এই হামলায় জড়িত।

পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ৩০ জনের বেশি ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় নতুন করে আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করার প্রয়োজন দেখছে না পুলিশ। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ১০ মিনিটে নিজ বাড়ি থেকে রবিউলকে আটক করে পুলিশ।

পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একটি হাতুড়ি, আলমারির চাবি, মই ও লাঠি উদ্ধার করা হয়। তবে রবিউল জানান, ঘটনার সময় ব্যবহূত কাপড়, টুপি ও মাস্ক পুড়িয়ে ফেলেছেন তিনি। সিসি ক্যামেরায় তার হাতে একটি ব্যাগ দেখা গিয়েছিল, যে ব্যাগে নতুন জামা-প্যান্ট ছিল।

এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন স্থানীয় যুবলীগ নেতা আসাদুল হক ও তার দুই সহযোগী নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার বিশ্বাস। তখন র‌্যাব দাবি করেছিল- ‘তারা এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করেছে। গ্রেপ্তার আসাদুল নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

এ ঘটনার মূল আসামি তিনি। পূর্বপরিকল্পিতভাবে চুরি করার উদ্দেশ্যে তারা ইউএনওর বাসায় ঢুকেছিলেন।’ এখন পুলিশের হাতে রবিউল ধরা পড়ার পর তদন্ত নতুন মোড় নিল। তবে এখনও অনেকের সংশয় রয়েছে। যদিও রবিউলকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সব প্রশ্নের জট খুলছে।


শর্টলিংকঃ