সুইডেনে হঠাৎ আলোচনায় বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি


বিশ্বের সব জায়গায় কম বেশি গসিপ হয়ে থাকে। আমরা স্বীকার করি আর না করি তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। তবে ঘটনা হলো আড্ডার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় পরচর্চা বা গসিপ। আপনি লন্ডনে বাস বা ট্রেনে কোথাও যাচ্ছেন, কারো সঙ্গে কথোপকথন শুরু হলো। কী বিষয়ে আলোচনা জমবে জানেন? ওয়েদার। “lovely weather isn’t it অথবা nasty weather isn’t it?”


বৃটিশদের গল্পগুজবের অন্যতম বিষয়বস্তু হলো আবহাওয়া। ইস কতদিন সূর্যের দেখা পাই না! প্রথমে এ ধরনের কথা শুনে আমার মনে হতো, কী অদ্ভুত জাতি এরা! দুনিয়ায় গল্প করার জন্য কত বৈচিত্র্যময় বিষয় আছে, আকাশ মেঘলা নাকি আলোকোজ্জ্বল, এটা নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে?

সুইডেনেও একই ঘটনা। তবে এরা টেনে ধরে গল্প করতে বা কাউকে বিনা কারণে বিরক্ত করতে পছন্দ করে না। কিন্তু আমি সুইডিশ এসব নিয়ম কানুন মানতে পারি না। যেমন প্রয়োজনে নিজ থেকে অপরিচিত লোকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি। কারণ একা একা চুপচাপ বসে নিজ মনে ভাবা আমার পক্ষে হয় না। তাই যে কোনো লম্বা জার্নিতে যদি একা থাকি পাশের কাউকে পেলেই গল্প জমিয়ে দেই।

ধরুন আট ঘণ্টার লম্বা পথ পেরোতে হবে। সঙ্গে যদি এমন কাউকে পান, কিছু না হলে অগত্যা ওয়েদার নিয়ে চমৎকার গসিপ করতে পারেন। তাহলে দেখবেন সময় কোন দিকে দিয়ে পার হয়ে গেছে বুঝতেও পারবেন না। তবে মনে রাখবেন অনেকে গসিপ পছন্দ করলেও গসিপ করতে পারে না। সবাইকে দিয়ে গসিপ হয়ও না, বিশেষ করে সুইডিশদের সঙ্গে।

কারণ এরা তাল মারতে, মিথ্যা কথা বলতে বা শুনতে পছন্দ করে না। তবে ওয়েদার নিয়ে একটু বাড়িয়ে বললে হাসি তামাশার মতো সহজভাবে নেয়।

একবার এক শীতের সময় হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। আমি সেসময় এক বান্ধবীর বাসায় দাওয়াতে এসেছি। সুইডেনে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে তাও ঠাণ্ডার সময়। ব্যাপারটা মনে ধরেছে বেশ। এর ওপর কথা বলতেই দেখি সবাই বেশ উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইল বাংলাদেশের শিলাবৃষ্টি এবং এর কারণে বড় আকারে প্রতি বছর যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা নিয়ে।

গল্প বলতে বলতে কোনো এক সময় বলে ফেলেছিলাম মাঝে মধ্যে দুই এক কেজি ওজনের শীল পরে আমাদের দেশে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করে এর কারণে। ঘটনাটিকে বান্ধবীর মা সিরিয়াসভাবে নিয়ে বেশ গবেষণা করে। মাসখানেক পর আবার যখন দেখা, তখন আমাকে বলেছিল “রহমান তোমার শীলের ওপর গল্পের সবই ঠিক ছিল তবে এক থেকে দুই কেজি ওজনের শীলের কোন তথ্য আমি কোথাও খুঁজে পাইনি।”

আমি একটু অবাক! গল্পের সময় ওজনটি না হয় একটু বাড়িয়ে বলেছি, সেটা নিয়েও গবেষণা? এই হলো সুইডিশ জাতি। কোন কিছু যদি তাদের না জানা থাকে, তবে প্রথমে বিশ্বাস করে। কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টির ওপর আরও তথ্য জানতে চেষ্টা করে। তথ্য ভুল দিলে এরা সেই ব্যক্তির ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে।

যাই হোক গসিপ নিয়ে অনেক কিছু জানা গেল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সুইডিশ জাতি সত্যিই সুন্দর মনের মানুষ। বন্ধুত্ব হলে জান দিতে প্রস্তুত। প্রতি বছর ঈদের সময় নতুন পুরোনো সব সুইডিশ বন্ধুদের আমি দাওয়াত করি। অবশ্য সবাই যে বন্ধু তা নয়। অনেকে প্রতিবেশী, অনেকে কাজের কলিগ, অনেকে আমার ছেলে-মেয়ের বন্ধু বা বান্ধবীর বাবা-মা।

স্কুল কলেজে পড়াকালীন সব ধর্ম সম্পর্কে এরা সচেতন। এক্ষেত্রে আমার সান্নিধ্যে ইসলাম ধর্মের আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারে। এই জানতে পারাটা তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায় এবং আমার সঙ্গে তাদের একটি ইন্টিমেট সম্পর্ক গড়ে উঠে। আমার কালচার, আমার ধর্ম এবং আমি মিলেই কিন্তু “পার্ট অব দিস সোসাইটি,” সেক্ষেত্রে নিজেকে বাংলাদেশের পাশে সুইডিশ ভাবতেও সমস্যা হয় না।

বর্তমানে যে বিষয়টির ওপর সুইডেনে বেশ আলোচনা হচ্ছে সেটা হলো বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি। এ দেশের সংবাদপত্র থেকে শুরু করে পরিচিত সবার মুখে এখন কথা একটিই “রহমান তোমার বাংলাদেশের বন্যার বর্তমান পরিস্থিতি কী আর কীভাবে বেঁচে আছে বেচারা মানুষগুলো?” বৃষ্টি প্রকৃতির এক আশীর্বাদ যার ছোঁয়া মরুভূমি থেকে শুরু করে সমতল বা পাহাড় বলে কথা নেই সর্বত্রই বিরাজমান।

তবে তা শুধু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে বাংলাদেশে এটা বড় কষ্টের। আমরা মনে করি কেন প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণ? স্বাভাবিক বৃষ্টি সব জায়গাতেই হয় এমনকি অনেক শহর ক্ষণিকের তরে পানিতে ডুবেও যায়। তবে কিছুক্ষণ বা কয়েকদিন পরে সে পানি সরে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বৃষ্টির পানি জমে থাকে এবং শেষে নানা ধরনের মহামারিসহ জীবননাশ করে আমাদের।

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের ভ্রমণের জন্য পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা শহর। বর্তমানে দেশের সর্বাধিক পর্যটকের সমাগমও হয় এখানেই। অতি প্রাচীন এ শহরটিতে প্রথমবার এসে কেউ যদি মনে করে কী নোংরা একটি শহর তাহলে তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।

ঢাকার সর্বত্রই কেমন যেন নোংরামির ছোঁয়া। যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু নোংরামির বিসর্জন দেওয়া হয়নি। বরং দিনের পর দিন তার পরিমাণ আরও বেড়ে চলেছে। ঢাকায় নতুন মেয়র নিয়োগ হচ্ছে কিন্তু ঢাকা শহর নোংরাই থেকে যাচ্ছে। পৃথিবীর সর্বত্রই যেখানে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে নানাভাবে সেখানে ঢাকার উন্নতি হলেও কেন যেন তাকে নোংরার অন্ধকারে আঁকড়ে রাখা হচ্ছে পরম যত্নে।

ঢাকায় আকাশছোঁয়া দালানকোঠার ভীড়ের চেয়ে দুই-এক লাখ বস্তি ধাঁচের বাড়িগুলো চোখে পড়ে বেশি। আবাসিক এলাকাসমূহে গেলে প্রথম দিকে মনে হবে এ কোন গোলক ধাঁধায় এসে পড়লাম! বর্তমানে ঢাকায় বাংলাদেশের গ্রামের মতো বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে বসবাসের রেওয়াজ নেই। সবাই যার যার সামর্থ্য মতো বাড়ি কেনে।

কিছু দিন থাকার পর ভালো না লাগলে সেটা বিক্রি করে আবার নতুন এলাকায়, নতুন ঢেঁড়ায় চলে যায়। বাড়িগুলোও এভাবে হাত বদল হতে থাকে। বাড়ির মালিকেরা বাড়ির অন্দরে ভেঙ্গেচুরে কিছুটা পরিবর্তন করে। তবে শহরের সিটি প্লান মেনে যদি সবাই কিছু করতো তবে বৃষ্টির পানি জমে রোগ বা মহামারি মৃত্যুর কবলে পড়তো না দেশের মানুষ।

ঢাকার বাইরে এখনও হাজার হাজার ঘরবাড়ি পানির নিচে। নলকূপ ডুবে থাকায় খাওয়ার পানির সংকটের পাশাপাশি ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধি ছড়াচ্ছে। দুর্গত লাখো মানুষ এখনো রয়েছে ত্রাণবঞ্চিত। কিছুই কী করার নেই? ঢাকাকে ফাঁকা করার কী কোন উপায় নেই? আর কতদিন চলবে এভাবে? সোনার বাংলা গড়ার সাধ কী মিটে গেছে আমাদের?

দূরপরবাস থেকে মনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে ইস! কী অপূর্ব সুন্দর, সাজানো, গোছানো ঢাকা শহর! কোথাও যেন কোনো বিচ্যুতি নেই। রাস্তার গাড়িঘোড়া থেকে শুরু করে কুকুরটিও যেন তাদের নির্ধারিত স্থান দিয়ে চলছে; একচুল এদিক সেদিক না করে। বিশ্বাস হচ্ছে না? কে জানতো করোনা এসে বিশ্বকে তছনছ করে দেবে! দেখবেন বাংলাদেশও একদিন সোনার বাংলায় পরিণত হয়ে গোটা বিশ্বকে চমক লাগিয়ে দিবে।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com


শর্টলিংকঃ