- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

জলদস্যু জুলফিকারের মায়ের মর্মস্পর্শী কাহিনী


 

বাংলাদেশের সুন্দরবনে কয়েক দশক ধরে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল যেসব জলদস্যু দল, তারা বিভিন্ন সময়ে আত্মসমর্পণ করেছে। ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের অবদান। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে জলদস্যুদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কীভাবে কাজ করেছে, সেকথা লিখেছেন তিনি। ধারাবাহিক এই লেখার আজ থাকছে  আত্মসমার্পণের আগে ক্রসফায়ারে নিহত জলদস্যু জুলফিকারের মায়ের মর্মস্পর্শী কাহিনী। 

জয়মনির ঘোল। পাশাপাশি দু’টি কবর। ক্রসফায়ারে নিহত দুই বনদস্যু জুলফিকার আর মর্তুজার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মা। চোখ দিয়ে টপটপ করে পড়ছে পানি। জড়িয়ে ধরে বলছেন, বাবা রে, দুইটা বছর আগে কেন আসলে না?

বনদস্যুদের আত্মসমর্পনের পর একদিন জয়মনিতে দেখা কুখ্যাত জুলফু ডাকাতের মা এর সঙ্গে। দুই ছেলে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। ক্যান্সার আক্রান্ত মা এর পাশে নাই সেই দস্যু ছেলের স্ত্রী-সন্তানেরা।

পশুর নদের পূর্ব পাশের চাঁপাই আর শরণখোলা সুন্দরবনের প্রায় পুরোটাই ছিলো তার দখলে। বঙ্গোপসাগরেও নিয়মিত দস্যুতা করতো তারা। দলের সদস্যদের সিংহভাগই ছিলো নিজেদের আত্মীয় স্বজন। জুলফু বাহিনীর জনবল ছিলো প্রায় শ’খানেক, অস্ত্র ছিলো দেড়শ’র মতো।

জুলফিকারের প্রথম স্ত্রীর ঘরে দুই ছেলে। এখন থাকে দাদীর সঙ্গে, জয়মনির ভাঙ্গা ছাপড়ায়। ছোট ভাই ইতালি থেকে টাকা পাঠায়। তাই দিয়ে চলে কোনো রকমে। মৃত্যুপথযাত্রী মা এর ক্যন্সারের চিকিৎসাও চালাচ্ছে সে।

বিরাট দস্যুনেতা বনে যাওয়া জুলফিকার পরে বিয়ে করে খুলনার এক সুশ্রী তরুনীকে। নাম সুলেখা (ছদ্মনাম)। আগের স্বামীকে ছেড়ে ঘর বাঁধে বনদস্যু জুলফুর সঙ্গে। সেই ঘরে জন্ম নেয় তিন কন্যা।

সুলেখার ভাই বোরহান (ছদ্মনাম)। দস্যুনেতার শ্যালক হিসেবে মাছের ব্যবসায় বেশ প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। পাশাপাশি বোন জামাই এর দস্যুতার টাকার পুরোটাই চলে আসে হাতে।

জুলফিকার যখন দস্যুতা শুরু করে, তখনও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দস্যুবিরোধী তৎপরতা শুরু হয়নি। সাধারণত তার বাড়ি জয়মনির উল্টোপাশে সুন্দরবনের নন্দবালা খালেই থাকতো দলবল নিয়ে। শুনেছি, এপার থেকে দু’বেলার খাবারও রান্না করে নিতো তার লোকজন। প্রশাসনের চাপ না থাকায় মন চাইলেই শহরে চলে যেতো, ফিরতোও ইচ্ছা মতো।

আবার মাঝেমধ্যেই সুলেখা যেতো সুন্দরবনে। দস্যু স্বামীর ডেরায় কিছুদিন কাটিয়ে আসতো। যাওয়ার পথে অস্ত্র-গুলি বহন করতো, দলের সদস্যদের ভাষ্য।

খুলনার নিরালায় একটা বাড়ি কিনেছিলো জুলফিকার। সেখানে থাকতো সুলেখা। মাঝে মাঝে নিজেও গিয়ে থাকতো সেখানে। খুলনার রূপসা আর গোবরচাটায় আরও দুটি বাড়ি ছিলো তার। শুনেছি, বাড়িগুলোসহ খুলনার আরও সম্পদের মালিকও সুলেখা আর তার ভাই বোরহান। ততোদিনে সুন্দরবন আর সাগরে মাছের ব্যবসা অনেক প্রসারিত হয়েছে। সে সময় বড় দস্যুবাহিনীগুলোর ইশারাতেই চলতো সুন্দরবন উপকূলের মাছের ব্যবসা। অর্থবিত্তে সুলেখারা ফুলে ফেঁপে একাকার।

এরই মধ্যে দস্যুবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। শুরু হয় অভিযান, ক্রস ফায়ার। বাঁচার জন্য ভারতে বসতি করার পরিকল্পনা শুরু করে জুলফু। সেদেশে থাকার সব ব্যবস্থাই চুড়ান্ত। কাগজপত্র করে জমি কিনতে যায় সে। সেখান থেকে দেশে ফিরে সোজা নিরালার বাড়ি। সেখান থেকে র‍্যাব এর হাতে আটক হয় দুর্র্ধষ সেই দস্যুনেতা। কয়েকদিন পরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় জুলফু বাহিনীর প্রধান, জুলফিকার।

শুনেছি, নিরালার বাসা থেকে বনদস্যু স্বামীকে ধরিয়ে দেয় সুলেখা। সে রাতে অনেকেরই দাওয়াত ছিলো ওই বাসায়। কিন্তু হয়তো আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিলো বাঁকীরা। সে দফায় বেঁচে যায় মর্তুজাসহ কয়েকজন।

কথিত আছে, দস্যুতার সাড়ে আট কোটি নগদ টাকা গচ্ছিত ছিলো সুলেখা ও তার শ্যালক বোরহানের কাছে। জুলফুর মৃত্যুর পর তার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সুলেখা ফিরে যায় আগের স্বামীর কাছে। নিহত জুলফুর শ্যালক বোরহান এখন বড় ব্যবসায়ী, অনেক ধন সম্পত্তির মালিক।

দস্যুতা চালানোর সময় জয়মনিতে তার এক মামাকে ১০ বিঘা জমি কেনার টাকা দিয়েছিলো জুলফু। জমিটি কেনা হয়েছিলো ঠিকই। তবে জুলফুর নামে নয়, মামা নিজের নামে দলিল করে নেন। দস্যুতার টাকায় এভাবে কতোজনের পকেট ভারী হয়েছে, তার হিসাব নাই।

অথচ জয়মনিতে বাপ দাদার ভিটায় একটি ছাপড়া ঘর ছাড়া কিছু নাই দাপুটে সেই জলদস্যুর। সেই ছাপড়া ঘরে তার মা থাকেন। ক্যান্সার আক্রান্ত মা এর পাশে নাই ছেলেটির স্ত্রী-সন্তানেরা। ইতালি প্রবাসী ছোট ছেলের পাঠানো টাকায় চলছে তার চিকিৎসা।

অনেকেরই প্রশ্ন, দস্যুতার কোটি কোটি টাকা যায় কোথায়? আমি জানি, সুলেখারাই এই অবৈধ উপার্যনের কেন্দ্রে ছিলো। ক্রসফায়ার হোক বা সারেন্ডার। সুলেখারা ভালোই আছে…

লেখক: মোহসীন উল হাকিম, বিশেষ প্রতিবেদক, যমুনা টিভি 

(চলবে)…