Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

সোভিয়েত দেশে দস্তয়েভস্কি


ইউএনভি ডেস্ক:

ফিওদর দস্তয়েভস্কির রচনা তথাকথিত ‘প্রচলিত রুশ মূল্যবোধের’ সঙ্গে ‘সংঘাতপূর্ণ’—এমন সমালোচনা তাকে তার জীবদ্দশাতেই সইতে হয়েছিল। বেঁচে থাকতে তার জীবনের পুরো সময়টুকুই কেটেছে জারের শাসনে। আর মানুষের মনের দগদগে ঘার আগাপাশতলা ও অসহায় ভয়ংকর প্রবৃত্তিগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া এ লেখককে রুশ জারতন্ত্র যে সহ্য করতে পারেনি, তা ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রেরই তো জানা।

দস্তয়েভস্কির মৃত্যুর প্রায় ৩৬ বছর পর রাশিয়ায় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত হলো রক্তাক্ত অথচ আশামুখর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব নামে সাধারণের পরিচিত এ দুনিয়া কাঁপানো ঘটনার পর নতুনভাবে তৈরি হতে থাকা সোভিয়েত রাষ্ট্রে দস্তয়েভস্কি নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত ও পঠিত হবেন, এমন আশা কেউ কেউ করেছিলেন তখন।

কিন্তু, রুশ কমিউনিস্টদের মনে দস্তয়েভস্কিকে ঘিরে দ্বন্দ্বের বীজ তার ঢের আগেই বোনা হয়ে গিয়েছিল। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠজন ম্যাক্সিম গোর্কি বিপ্লবের কয়েক বছর আগেই ১৯১৩ সালে মস্কোয় দস্তয়েভস্কির ‘শয়তান’ উপন্যাসিকাটির নাট্যরূপ দেখে আয়োজকদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশের পাশাপাশি তার পূর্বসূরি লেখককেও এক হাত নিয়েছিলেন এই বলে যে ‘এরা সবাই জার-শাসনের হাত শক্ত করতেই কাজ করছে।’ গোর্কির এ আগুনখেকো মন্তব্য স্বভাবতই সাধারণ পাঠকমহলে সমালোচনা তৈরি করেছিল।

অবস্থা বেগতিক হওয়ায় জবাবে গোর্কি যা বলেন, তা আগের চেয়ে অনেক বেশি সহনশীল ও নরম সুরের বয়ান: ‘এর সবই আদতে সাহিত্যিক মতামত, যতটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু শেষমেশ দস্তয়েভস্কি একজন প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি এবং তিনি সেই জান্তব জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যা কিনা এখন আমাদের গলা চেপে ধরছে। …যদিও তিনি একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী, ইহুদি-বিদ্বেষী, নিয়তিবাদের প্রচারক—তা সত্ত্বেও তিনি এত মহান শৈল্পিক প্রতিভার অধিকারী যে তার সব পাপই মানবজাতির সেরা নেতাদের হাতে তৈরি বিচারসভা-আইনের ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে।

সর্বোপরি, তার প্রবণতাগুলোকে বিচার করার অধিকার সমাজের হাতে নেই। আর সাধারণভাবেই কোনো শিল্পী যা-ই প্রচার করুক না কেন তার সমালোচনা করার অধিকার সমাজ রাখে না।’ ১৯৩৪-এ প্রথম সোভিয়েত লেখক সম্মেলনে গোর্কি আবার উল্টো কথা বলেন: “দস্তয়েভস্কির প্রতিভা প্রশ্নাতীত। তার শৈল্পিক চিত্রায়ণের ক্ষমতা বলা চলে শেক্সপিয়রের সমান। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বকে যখন ‘পুরো পৃথিবী ও এর মানুষ’ সম্পর্কে যতটা সম্ভব উদ্বিগ্ন দেখা যায়, তখন তিনি কোনো মধ্যযুগীয় ধর্মসভার বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলে যে কেউ খুব সহজেই ধারণা করতে পারে বৈকি।”

দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায় ১৯১৪-র জুনে ইনেসা আরমান্দকে লেখা স্বয়ং লেনিনের এক চিঠিতেও। ইউক্রেনের রাজনীতিবিদ ও লেখক ভ্লাদিমির ভিনিশেঙ্কোর উপন্যাস ‘পিতাদের জবানবন্দি’-র সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘[উপন্যাসটি] আমার মতে অতি বাজে দস্তয়েভস্কির বাজে অনুকরণমাত্র।’ ‘বাজে দস্তয়েভস্কি’—এই শব্দবন্ধের মধ্যে তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত আর প্রচ্ছন্ন থাকে না। দস্তয়েভস্কির ‘শয়তান’ কেউ তাকে পড়ার জন্য দিয়েছে জানিয়ে এক সভায় তিনি নাকি এও মন্তব্য করেছিলেন যে ‘[বইটি] একেবারেই বাজে, পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশীল রচনা। এটা পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো আগ্রহ আমার নেই। এ রকম সাহিত্য পড়ার দরকার কী আমার! আমাকে কী ভেবে কেউ এমন একটা বই দিতে পারে?…এ আবর্জনার জন্য আমার ফুরসত বরাদ্দ নেই।…’

‘শয়তান’-এর মতো ছোট উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে লেনিনের দস্তয়েভস্কি-পাঠের ইতিনেতি বিচার করা চলে না, এমনটা তর্কের খাতিরে কেউ কেউ বলতে পারেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে লেনিন পছন্দ করেননি ‘অপরাধ ও শাস্তি’ এবং ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’-র মতো বৃহদাকৃতির মানববিশ্ব কাঁপিয়ে দেয়া উপন্যাসদ্বয়ও। ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য এমন, এটি ‘শয়তান’-এর মানের লেখাই—এর বেশি কিছু নয়: ‘আমি কটুস্বাদের উভয় রচনার [‘কারামাজভ ভাইয়েরা’ ও ‘শয়তান’] সঙ্গেই পরিচিত।

এবং তা আমার জন্য যথেষ্টেরও বেশি। ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’ আমি পড়া শুরু করতে না করতেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। মঠের দৃশ্যগুলো আমাকে অসুস্থ করে তুলেছিল।’ আর একবার তার এক সহযোগী কমরেড কোনো একটি বিষয়ে কথায় কথায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘এমনভাবে সবকিছু চলতে থাকলে যে কেউ রাসকোলনিকভের [‘অপরাধ ও শাস্তি’র প্রধান চরিত্র] ‘সবকিছুই সঙ্গত’ ধারণায় একমত পোষণ করবে।’ লেনিনের প্রশ্ন, ‘কোন রাসকোলনিকভ?’ জবাব আসে, ‘দস্তয়েভস্কির রাসকোলনিকভ, ‘অপরাধ ও শাস্তি’ বইয়ের।’

এ কথা শুনেই লেনিন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, ‘তাহলে তো আমরা বিপ্লববিষয়ক প্রশ্নকে একজন ভাবপ্রবণ বুদ্ধিজীবীর তুচ্ছ শব্দাবলি ও অনুভূতির বমনে চুবিয়ে দেয়ার পর্যায়ে নেমে এসেছি। তুমি কোন রাসকোলনিকভের কথা বলছ হে? যে কিনা সেই বৃদ্ধা কর্জদাতাকে মেরে ফেলেছিল, নাকি যে পরে অনুশোচনায় বাজারের মধ্যে কাতরাতে কাতরাতে মাটিতে নিজের মাথা ঠুকছিল?… এসব বিষয়ও তোমাকে আকর্ষণ করে?…’ ‘অপরাধ ও শাস্তি’ এবং রাসকোলনিকভ বিষয়ে লেনিনের কড়া উষ্মা এখানে দেখার মতো।

আবার দস্তয়েভস্কির বিষয়ে গোর্কির মতো লেনিনের অবস্থানও ছিল স্ববিরোধী। একবার এক খসড়া লেখায় দস্তয়েভস্কিকে দেয়া জার নিকোলাসের শাস্তি ও পরে ক্ষমাপ্রদান বিষয়ে তিনি সহমর্মিতার সঙ্গে মন্তব্য করেছেন বলে নজরে আসে। আবার দস্তয়েভস্কির উপন্যাস ‘হাউজ অব দ্য ডেড’ নিয়ে তার মন্তব্য ছিল একান্তই ইতিবাচক: ‘[উপন্যাসটি] রুশ সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্যের একটি অতুলনীয় নিদর্শন, যা কিনা শ্রমশিবিরগুলো শুধু নয়, বরং সেই ‘মৃতদের ঘর’-কেও অসামান্য আকারে চিত্রায়িত করেছে—যাতে কিনা হাউজ অব রোমানভের জারদের অধীনে তারা বসবাস করত।’ আরো জানা যায়, বিপ্লবের কিছুদিন পরই রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ২০ জন বিখ্যাত রুশ লেখকের ভাস্কর্য বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন লেনিন—যে তালিকার দুই নম্বরেই ছিল দস্তয়েভস্কির নাম, আর পয়লাজন ছিলেন লেভ তলস্তয়।

এটা সম্ভবত অনেকেরই কাছে অজানা, জোসেফ স্ট্যালিনও দস্তয়েভস্কির রচনা মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন। গবেষক বসির ইলজারভ খুঁজে পেয়েছিলেন স্ট্যালিনের সংগ্রহ করা ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’-র একটি কপি। বইটি ১৯২৭ সালে কেনা হয়েছিল। কিন্তু স্ট্যালিন তা পড়েছিলেন সম্ভবত তিরিশের দশকের প্রথমার্ধ জুড়েই। আরো কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই, লেনিন ওই উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত যে মঠের দৃশ্যাবলির নিন্দা করেছিলেন তীব্রভাবে—স্ট্যালিন সেই অংশগুলোই অধিকতর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। লাল ও নীল—দুই রঙের পেন্সিলে বারবার বইটির বহু লাইন তিনি দাগিয়ে রেখেছিলেন।

বিশেষ করে নজর কাড়ে একটি লাইনের নিচে তার দেয়া লাল পেন্সিলের দাগ: ‘আমি…তুমি কী জানো…আমি একজনকে খুন করেছি।’ তবে তাই বলে স্ট্যালিনের প্রতাপশালী হয়ে ওঠার সময়পর্বে সোভিয়েত মহলে দস্তয়েভস্কির বিশেষ কদর হয়েছিল এমনটাও ঠিক নয়। বরং ওই সময়েই মিখাইল বাখতিন দস্তয়েভস্কির রচনার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে ‘প্রবলেমস অব দস্তয়েভস্কিস পোয়েটিকস’ শিরোনামে তিনশতাধিক পৃষ্ঠার এক বিরাট অভিসন্দর্ভ ফেঁদে বসেন।

সেখানে দস্তয়েভস্কির খুঁত ধরার জন্য বহু উদ্ভট ও সারহীন কসরত পণ্ডিত বাখতিন করেছিলেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। সোভিয়েত জনতার মনোবল বাড়াতে যেসব প্রচারণা চালানো হচ্ছিল ওই সময়, সেসবে দস্তয়েভস্কিকেও ‘মহান দেশপ্রেমিক লেখক’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। যুদ্ধের ময়দানে যে এভাবে তাকে কাজে লাগানো হবে, তা দস্তয়েভস্কি নির্ঘাত কস্মিনকালেও ভাবতে পারতেন না।

স্ট্যালিন-যুগের অবসান হওয়ার পর যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে খানিক বাহ্যিক উদারতার হাওয়া বইতে শুরু করে, তখন দস্তয়েভস্কি নতুন করে সেখানে আবিষ্কৃত হতে থাকেন। কিন্তু এখানেও খানিক আবছায়ার খেলা যেন, ইংরেজিতে দস্তয়েভস্কির প্রধান উপন্যাসগুলোর অনুবাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা সংস্থা ছেপে ঠিকই বের করলেও পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায়—বাংলার কথাই ধরা যাক, কেবল অনূদিত হয় ‘বঞ্চিত-লাঞ্ছিত’ কী ‘অভাজন’-এর মতো উপন্যাসগুলো। যেন স্রেফ ‘শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের আখ্যান’ই লিখে গেছেন তিনি।

অন্যদিকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাহিত্য বিভাগের আমলা হওয়ার সুবাদে গৌণ লেখক কনস্তানতিন সিমনভের ‘জীবিত ও মৃত’-এর মতো নিছক প্রোপাগান্ডাতুল্য নিরস উপন্যাসও অনূদিত হয় একাধিক ভাষায়। তবে তুলনামূলক উদার সোভিয়েত রাষ্ট্রও কি তখন ‘ইডিয়ট’, ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’ বা ‘অপরাধ ও শাস্তি’-র দস্তয়েভস্কিকে ভয় পাচ্ছিল? বস্তুত—কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে দস্তয়েভস্কির সম্পর্কটা যেন ছিল স্ববিরোধী। তাকে গেলাও যায়নি, ফেলাও যায়নি।

 

শাকের আনোয়ার: প্রাবন্ধিক


Exit mobile version