- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

‘হামার কিসের ঈদ বাহে’


কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর সদর উপজেলার যাত্রাপুর নদীবন্দর। ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, শিয়ালদহ, বোয়ালমারী আর গঙ্গাধর মিলেমিশে প্রবাহিত হচ্ছে এটা ঘেঁষে। এখান থেকে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় এক ঘণ্টা যাওয়ার পর চর রলাকাটা দ্বীপচর। মাঝখানে নদী, তার ওপারে এক কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত।

সীমান্তে ভারতের বিএসএফের ছালাপাড়া বিওপি। দ্বীপচরের অবস্থিত এই বিওপি তারা অনেক উঁচু করে নির্মাণ করেছে, যাতে বন্যায় তলিয়ে না যায়। এ জন্য দূর থেকেই অনেক কিছু দেখা যায় সেটার। কিন্তু সীমান্তের এপারে আমাদের চর রলাকাটা গ্রামটি দেখা যাবে না আর।

বানের পর ভাঙনে গ্রামটি বিলীন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। সর্বশেষ যে দুটি পরিবার চরটিতে ছিল, তারাও বুধবার ঘরবাড়ি সরিয়ে স্বল্প দূরে জেগে ওঠা নতুন একটি চরে এসে ঠাঁই নিয়েছে। আর যাবেই বা কোথায়, যাওয়ার মতো তাদের আর কেনো জায়গা নেই।

চর রলাকাটার আব্দুস সালাম (৫০), স্ত্রী সবজান বেগম (৪০), ছেলে আবু হাসান (২২) ও আবু সাঈদ (১৬) মিলে কিছু টিন, কাঠ ও খড়ের বেড়া আর সামান্য কিছু আসবাব নৌকায় নিয়ে নতুন চরে যাচ্ছিলেন। বাড়ি বলতে তাদের এখন এসব। বৃষ্টি পড়ছিল কখনও মুষলধারায়, কখনও হালকা। ঘণ্টাখানেক পর কড়া রোদ। এসব উপেক্ষা করে তারা চর ছাড়ছিলেন দ্রুত। আব্দুস সালাম জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে অবস্থিত এই দ্বীপচরে ১৭৫টি পরিবার বসবাস করত।

গত ২০১৭ সালের বন্যায় বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি অব্যাহত ভাঙনের কবলে ৭৫টি পরিবার এ চর ছেড়ে চলে যায়। এরপর গত বছর ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যত্র চলে যায় আরও ৫০টি পরিবার। অবশিষ্ট ছিল ৫০টি।

এবারের ভয়াবহ বন্যায় তাদের বাড়িঘর তলিয়ে ছিল ২৫ দিন। শুধু তাই নয়, পানির তীব্র স্রোত দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে প্রতিটি বাড়িঘর। সে সময় পার্শ্ববর্তী ভগবতী চরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের উঁচু জমিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা।

বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর চরে ফিরে এসে ভেঙে যাওয়া ঘরগুলো কোনোরকমে খাড়া করে মাথা গোঁজার চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু বিধি বাম। বানের পানি সরে যাওয়ার পর নদীর পানি যত কমছে, ভাঙনের তীব্রতা তত বাড়ছে।

ফলে নতুন করে বিধ্বস্ত ঘরগুলো ঠিক করার আগেই মাত্র এক সপ্তাহে ৩০টি পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। ভাঙনের তীব্রতা বাড়ায় চলে গেছে অবশিষ্ট ২০টি পরিবারও। তারা হচ্ছে চর ছেড়ে যাওয়া সর্বশেষ পরিবার। ফলে বৃহস্পতিবার থেকে চরটি জনশূন্য হয়ে পড়েছে একেবারে।

আব্দুস সালাম জানান, কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভর করে তিনি সংসার চালান। জমিজমা বলতে কিছু নেই। বাড়ি-ভিটার ছয় শতাংশ জমি ছিল সম্বল। তাও নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে।

ঈদের কথা বলতেই বেশ জোরেশোরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আব্দুস সালাম, ‘হামার কিসের ঈদ বাহে। জীবনই তো বাঁচে না।’ যাত্রাপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যে আব্দুস সালামের মতো ঈদের আমেজ নেই। অথচ জেলার সবচেয়ে বড় কোরবানির গরুর হাট এই যাত্রাপুরে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানালেন, তার ইউনিয়নে ১৪টি দ্বীপচরসহ ৩২টি গ্রাম রয়েছে। সব গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে ছয় হাজারের বেশি পরিবার বানভাসি হয়েছে। বন্যাকবলিত হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলাসহ ফসলের ক্ষেত।

পুকুর-দীঘি তলিয়ে যাওয়ায় মৎস্যচাষিরা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে কিংবা দুমড়েমুচড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২৮টি বাড়িঘর। আর বন্যার পর নদী ভাঙনের শিকার হয়ে চর রলাকাটা, চর ভগবতীপুর ও ঝুনকার চরে এ পর্যন্ত ৪৩টি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে।

তিনি আরও জানান, বন্যার্তদের সহায়তায় এ পর্যন্ত সরকারের জিআর হিসেবে বরাদ্দ পেয়েছেন সাড়ে ১৯ মেট্রিক টন চাল। এ চাল ১০ কেজি করে এক হাজার ৯৫০টি পরিবারকে দিয়েছেন। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় পাঁচ হাজার ৩৮৪ পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।

গৃহনির্মাণ মঞ্জুরির টিন বা টাকা এখনও বরাদ্দ পাননি। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিস্থিতিতে এই ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ঈদের কোনো আমেজ নেই।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা খায়রুল আনাম জানান, এবারের বন্যায় জেলার ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নের ৮৯৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে বন্যার কবলে পড়েছিল দুই লাখ সাড়ে ৩৮ হাজারের পরিবারের প্রায় ৯ লাখ ৫৮ হাজার মানুষ। সেইসঙ্গে বন্যার কবলে পড়েছিল দুই লক্ষাধিক গবাদিপশু।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে সরকারের ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ফলে কোনো প্রকার মানবিক বিপর্যয় ঘটেনি। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে গৃহনির্মাণ মঞ্জুরি সঠিকভাবে প্রদানের জন্য তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এ কাজ শেষে গৃহনির্মাণ মঞ্জুরির টাকা ও ঢেউটিন বিতরণ করা হবে।্কৃতজ্ঞতাঃ সমকাল