হোম কোয়ারেন্টাইনের আগে মানসিক প্রস্তুতি


আমি একা  থাকতে পারি না।একা থাকলেই নিস্তব্ধতা আমাকে চেপে ধরে। বিভিন্ন চিন্তা কুড়ে কুড়ে খায়। এখানে আসবার আগের দিনই ঘোষণা পেলাম, দেশে ফিরলে ১৪দিন আইসোলেশন এ থাকতে হবে।পাত্তা দিইনি প্রথমে। পরের দিনই যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, নোটিশ আকারে খবর পেলাম দেশে ফিরলে ১৪ দিন গৃহে এক কামরাবন্দি থাকতে হবে।কেন যেনো খুব বেশি খারাপ লাগছিল না শুনে।বড় বেশি ব্যস্ততায় কেমন যেন খাপছাড়া লাগছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল, গুছিয়ে নেয়ার এই তো সময়।

আকাশ তো ঝকঝকেই হয়।কিন্তু মেলবোর্নের আকাশটা যেনো আমার মতো শখের আবৃত্তিকার এর উচ্চারিত চ/ছ এর মতো না। শিমুল মুস্তাফা বা মাহিদুল ইসলাম এর মতো জাত আবৃত্তিকার এর উচ্চারিত চকচকে ‘চ’ এর মতো। মানে আকাশের নীল ও আছে,সাদা মেঘ ও আছে।কিন্তু কোন কুয়াশা নেই।বৈপরীত্য যেটা আছে ঠাণ্ডা বাতাস।

আমাদের দেশে এই ঠাণ্ডায় রোদের বা সূর্য মামার দেখা মেলে না সাধারণত। দেখা যখন মেলে তখন ঠাণ্ডা কেটে যায়।এখানে মোটা কোট গায়ে, চাদর জড়ানো মাথায়।তবু বেশ টের পাওয়া যায়। এমন ঠাণ্ডা মানে কিন্তু শীতকাল নয়।আমার কাজিন জাস্ট দুদিন আগেই আমাকে বলেছে, এখানে এখন গরম। শীতের কাপড় লাগবে না।সেই কারণে আমি আর লাগেজ ভারী করিনি।কিন্তু মেলবোর্ন এর কঠিন সুন্দরী ইমিগ্রেশন অফিসার এর স্মার্ট জেরায় জেরবার পার হয়ে যখন পা রাখলাম রাস্তায় গাড়ির সন্ধানে, তখনই টের পেলাম যে একটু ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কনকনে বাতাস।যাই হোক, বুদ্ধি দিয়েছেন যিনি তার মাধ্যমেই উত্তরণ।তিনিই তার শীতবস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন।আর তাই আমি এখন ইয়ারা নদীর পাড়ে সাতসকালে শীত-রোদ-নদী বিলাস করতে পারছি আরাম করে।

ব্যস্ত মেলবোর্ন এর বুক চিরে নদী চলে গেছে।নদীর এপারে আমার হোটেল আর ওপারে কনফারেন্স সেন্টার। তার মানে এই না যে আমাকে ফেরি পার হয়ে কিংবা স্পীড বোটে করে ওপারে যেতে হয়।আমি শুধু ১০ টি মিনিট পদযুগল ব্যবহার করলেই ওপারে কনফারেন্স সেন্টার এ পৌঁছে যাই।কিন্তু সেখানে পৌঁছে মোটামুটি আরও দশ মিনিট হাটতে হয় আমাদের বরাদ্দকৃত ভেন্যু নাম্বার ১০এ পৌঁছাতে।অর্থাৎ সেটা এতোখানিই বড় এবং একসাথে অনেকগুলো কনফারেন্স /এক্সিবিশন চলতেই থাকে।

রাতের ইয়ারা নদী, মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়া

আজ অবশ্য কনফারেন্স বন্ধ। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে শেষের আগের দিন বিকেলে কনফারেন্স কনভেনর ডায়াসে উঠে সরকারি নোটিশ খানা জানিয়ে, ডিনারের দাওয়াত দিয়ে শেষদিনের পর্ব বন্ধ ঘোষণা দিলেন।আর তাই সকালের নাস্তা সেরে আমি ইয়ারা নদীর পাড়ে চলে এলাম।নামেই  নদী। কিন্তু আদতে ঢাকার হাতির ঝিলের থেকেও সরু।নদীর পানি ঝকঝকে নয়,চমৎকার নীল আকাশ তার ছায়া দিয়েও তাকে নীল করতে পারছেনা।প্রমাণ করছে যেন সবাই সবকিছু ধারণ করতে পারে না।কিন্তু বাকি সবকিছুই ছিমছাম।

নদী-সাগর বরাবরই আমাকে টানে।নদীর উপরে উঠি আর নাই উঠি,সাঁতার জানি না।  তাতে কী! পাড়ে বসে থেকে উদাস হতে আমার খুব মন টানে।দুভার্গ্য যে আমার দেশে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে কিংবা কক্সবাজারের ধারে একা নারীকে কেউ এই সুখ কেউ করতে দেবে না।এই কারণে এখানে একা বসে সেই সুখ-ই কুড়াচ্ছি। মধ্যরাতে এই পারে হাঁটলেও বোধ কোন সমস্যা হবে না।সেই চেষ্টা অবশ্য এই যাত্রায় করা হলো না।পরের কোন একবারের জন্য রেখে দিলাম।এ যাত্রায় এই সুখটুকু আগে হজম হোক।

হাতে একটা কফির মগ থাকলে ভালো হতো।এই অনুভূতি থেকে পাড় বরাবর একটু হেটে কিছু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখি রীতিমতো ফুড জোন।সারি সারি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা।উঁচু ভলিউম এ গান বাজছে।বেশ গরম লাগছে কেন।আরে হেব্বি জিনিস তো! জায়গায় জায়গায় লাইট পোস্টের মতো এক একটা পোস্ট আর তাতে কয়লা জ্বলা আগুন।আশপাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে আরামদায়ক উষ্ণতা। উপযুক্ত গান আর সাউন্ডবক্স থেকে দূরত্ব বেছে নিয়ে খাবারের মধুর অপেক্ষায় থাকলাম।

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে লেখক

এই সময়ে আমি কোন নতুন খাবারের টেস্ট নেয়ার সাহস করলাম না।বার্গার আর কফি।বার্গারটা খেয়ে কফিটা টেক এউয়ে করে হাটা দেয়ার প্ল্যান। পরিচিত গান বাজছে “কান্ট্রি রোড টেক মি হোম,ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া..টেক মি হোম”…

আবার উদাস হওয়ার পালা।২০০৭সালে একবার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া স্থায়ীভাবে আসার।আইএল্টস করলাম অনেকদিন ধরে।বিভিন্ন সেন্টার ঘুরে ঘুরে সাব্জেক্ট পছন্দ করলাম।হায় কী অদ্ভুতভাবে সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়া হয়েছিল, সেই গল্প আরেকদিন বলবো।এই যে নিজের মতো থাকা এটা একজন মানুষের কতখানি পছন্দ হতে পারে।এর বিনিময়ে সে কতটুকু ত্যাগ করতে পারে? যারা গ্রহণযোগ্যমাত্রার জীবন যাপন করে দেশে, তাদেরকে কী তাড়িত করে বিদেশে এসে থিতু হতে আমার জানতে ইচ্ছে করে।এইবার সুযোগ এসেছে,ছলে বলে কৌশলে যদি প্রবাসীদের কাছে থেকে একথা জানতে পারি তবে মন্দ হয় না।

হাঁটতে হাঁটতে বেশ খোলা এক মাঠের মাঝখানে চলে আসলাম।বাচ্চারা খেলছে।বিশাল বড় কাঠের ডিজাইনের একটা বেঞ্চ পাতা।বসলাম নদীর দিকে মুখ করে।এখান থেকে ব্রিজটা অনেক দূরে।কিছু লোক একসাথে একটা নৌকায় করে ঘুরছে।চোখে-মুখে আনন্দ। আবার আমার থেকে একটু দূরে একজন ভবঘুরে, সারা শরীর এ যার ট্যাটু আকা ক্যম্পখাটের উপর সংসার গেড়ে বসে আছে সেও সুখী।তার আশেপাশে বিয়ার আর ওয়াইনের বোতলের ছড়াছড়ি। সে উঠে যেতে যেতে আমার পাশে বসা এক ইন্ডিয়ান কাপলের কাছে স্মার্টলি সিগারেট চাইলো।পুরো প্যকেট পাশে রেখে তাদের ও স্মার্ট জবাব -স্যরি দিতে পারছি না।এরাও সুখী।

সুখ তো আসলে খুজেই নিতে হয়।তুচ্ছ কোন ঘটনা থেকে,নিজের দৈনন্দিন জীবন থেকে।মনকে সেটা মানতে শিখতে হবে তার আগে। যুগলবন্দীর দিকে মনোযোগ দেয়া যাক- ছেলেটার চোখে মুখ এ বিরহ ভাব প্রবল।উপরের দিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার ভাব আর নারীটির দিকে কোমল চাহিনীতে তার ছাপ আছে।কিন্তু মেয়েটি উৎফুল্ল -সাবলীল।একটু পর পর উঠছে,কখনো নদীর ধারে ছবি তোলার পোজ দিচ্ছে, কখনও বা রাস্তায় বসে, দাঁড়িয়ে হাত ছড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায়।

এদের রসায়ন নিয়েই হয়তো সাহিত্যিক বা গল্পকার গল্প খুঁজে পাবে।আমি শুধু তার ছোয়াটুকুই পেলাম। একটা পর্যায়ে তার হাত ধরাধরি করে উঠে গেলো।রাস্তায় উঠে দুজন খুব আনাড়ীভাবেই স্বল্প একটা চুমু বিনিময় করে দুদিকে চলে গেলো।কি আশ্চর্য। এ আবার কেমন গল্প।ছেলেটা পৌঁছে দেবে না মেয়েকে নাকি এখানেও চিরাচরিত এদের কেউ দেখে ফেলার ভয় আছে/নাকি সময় স্বল্পতা।কী জানি।

আমি ও উঠলাম।কাছে ধারেই নাকি কি একটা রোড আছে। যার দেয়ালে যে যার মতো একে রেখেছে। স্ট্রিট আর্ট দেখতে হলে ওখানে যাওয়া ম্যান্ডিটরি।গুগল ম্যপকে তড়িৎ ইশারা জানালাম-মামা নিয়ে যাও মোরে…

(চলবে)

ডা. শরমিন আক্তার সুমি : সহকারী অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগ,

শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড সার্জারি, ঢাকা।


শর্টলিংকঃ