হ্যাট্রিকসেরা রাজশাহী কলেজ


বিশেষ প্রতিবেদক :

অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের র‌্যাকিংয়ে টানা তৃতীয়বারে দেশসেরা হয়েছে রাজশাহী কলেজ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাকিংয়েও টানা তিনবার দেশের সেরা কলেজ নির্বাচিত হলো। কলেজটি প্রায় দেড়শো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। হাজারো জ্ঞানী-গুনি এ বিদ্যাপীঠের আলোয় আলোকিত হয়ে এখন আলো ছড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশে। 

রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবন

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে ‘কলেজ পারফরমেন্স র‌্যাংকিং’-এ জাতীয় পর্যায়ে আবারো রাজশাহী কলেজ সেরা হয়েছে। এ নিয়ে রাজশাহী কলেজ তৃতীয়বার সেরা কলেজ হওয়ার গৌরব অর্জন করল। সোমবার দুপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ তার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাংকিংয়ের ফলাফল ঘোষণা করেন।

রাজশাহী অঞ্চলের সেরা ১০টি কলেজ হলো- রাজশাহী কলেজ, বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ কলেজ, বগুড়ার সৈয়দ আহমদ কলেজ, সিরাজগঞ্জের হাজী ওয়াহেদ মরিয়ম কলেজ, সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ, রাজশাহীর দাওকান্দি কলেজ, রাজশাহী কোর্ট কলেজ ও নাটোরের এন. এস. সরকারি কলেজ।

রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান ইউনির্ভাসাল টোয়েন্টিফোরকে জানান, ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সব কলেজের ৩১ কেপিআই (কি পারফরমেন্স ইন্ডিকেটরস) র‌্যাংকিং শুরু হয়। এবার তৃতীয়বারের মতো র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথমবারও রাজশাহী কলেজ সেরা হওয়ার পর এবারও সেরার মান অক্ষুন্ন রেখেছে এ কলেজ।  এবারো রাজশাহী কলেজ সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করায় তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন।

জানা গেছে, কলেজের অধ্যক্ষ আরো জানান, দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ কলেজটি দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবারো স্থান ধরে রেখেছে। পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিখ্যাত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু, উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি স্যার যদুনাথ সরকার, বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃত অন্যতম সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, জননেতা ও শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, বাংলাদেশের ৪ জাতীয় নেতার একজন এএইচএম কামারুজ্জামানের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এ কলেজের ছাত্র ছিলেন। এ কলেজের সবুজ চত্ত্বরে ছিলো তাদের পদচারণা।

রাজশাহী কলেজের প্রধান ফটক

একবিংশ শতব্দীর প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজশাহী কলেজ ডিজিটাল করে নিয়েছে নিজেকে। কলেজের নিরাপত্তা বিধান করতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ওয়াইফাই সুবিধা দেয়া হয়েছে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে এখন দর্শনীয় স্থান হিসেবেও গড়ে উঠেছে উত্তরের এ কলেজটি।

অধ্যক্ষ বলেন, কলেজে পাঠদানে ইতিবাচক প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে শিক্ষার মানোন্নয়নে তারা নিরলস কাজ করেন। আগামীতেও এ কলেজকে তার গৌরব ধরে রাখার চেস্টা করবেন ।

জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের ঐতিহ্যবাহী শীর্ষ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী কলেজ প্রায় দেড়শো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। হাজারো জ্ঞানী-গুনি এ বিদ্যাপিঠের আলোয় আলোকিত হয়ে এখন আলো ছড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশে। এবারো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিয়ে দেশ সেরার তালিকায় অক্ষুন্ন রয়েছে এ কলেজটি।

একজন ইংরেজ প্রকৌশলীর পরিকল্পনায় ১৮৮৪ সালে একষট্টি হাজার সাতশ টাকা ব্যয়ে বর্তমান প্রশাসন ভবনটি নির্মিত হয়। গাঢ় লাল বর্ণের দোতলা ভবনটি কালের গ্রাস জয় করে নগরীর প্রধান ও প্রাচীনতম সড়কের পাশে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর পর একে একে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসস্থল, অধ্যক্ষের বাসভবন।

সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজশাহী কলেজে গড়ে উঠেছে পাঁচটি বিজ্ঞান ভবন, দুইটি কলাভবন, ইংরেজি বিভাগের জন্য একটি পৃথক ভবন; পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ‘গ্যালারি ভবন’ যা প্রখ্যাত দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসীন ভবন নামে পরিচিত। রাজশাহী কলেজে ১৯২৯ সালে ডিসেম্বরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ঘটেছিল। তিনি রাজশাহী কলেজের সে সময়ের শিক্ষার্থীদের সাথে তিন রাত্রি যাপন করেছিলেন। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনারটি প্রথম নির্মিত হয়েছিল রাজশাহী কলেজেই।

অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান

রাজশাহী কলেজে পরীক্ষার ফলাফল বরাবরের মত বর্তমানেও অনেক ভাল। শিক্ষাবোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্য কলেজের উন্নত শিক্ষামানের সাক্ষ্য বহন করে। উল্লেখ্য, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ববাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে পাঠদান করা হতো। সে সময় অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা থেকে শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের জন্য আসতেন। শতাব্দী প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং পন্ডিত ও গবেষকদের জন্য এক অনন্য গবেষণাক্ষেত্র হিসাবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বর্তমান রাজশাহী কলেজ পঁয়ত্রিশ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর ক্যাম্পাস। সামনে তাকালে যেখানেই ফাঁকা জায়গা সেখানেই একটি ফুলের বাগান। ধুমপান ও মাদকমুক্ত এই ক্যাম্পাস গ্রীন ক্যাম্পাস ও ক্লিন ক্যাম্পাস নামে পরিচিত। পঁয়ত্রিশ একর পরিসীমার এ কলেজ ক্যাম্পাসে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন বিভিন্ন ভবন, শহীদ মিনার, রবীন্দ্র-নজরুল চত্বর, পাড় বাঁধানো একটি পুকুর, সুদৃশ্য মসজিদ, মন্দির এবং দুটি খেলার মাঠ। ক্যাম্পাসটি নানান বিরল প্রজাতির বৃক্ষ দ্বারা শোভিত।

১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ঐতিহ্য ভবন খ্যাত একটি দ্বিতল প্রশাসন ভবনসহ ১২টি একাডেমিক ভবন রয়েছে। এগুলো হলো, প্রশাসনিক ভবন, হাজী মুহম্মদ মহসীন ভবন, ফুলার ভবন, পদার্থবিজ্ঞান ভবন, প্রথম বিজ্ঞান ভবন, দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবন, তৃতীয় বিজ্ঞান ভবন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভবন, শহীদ এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান একাডেমিক কাম এক্সামিনেশন ভবন, কলা ভবন, ইংরেজি ভবন এবং রসায়ন ভবন। সুপরিসর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ ২৩টি বিভাগের ২৩টি সেমিনার লাইব্রেরি এই কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগকে বিস্তৃত করেছে।

বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান এবং উপাধ্যক্ষ প্রফেসর আল ফারুক চৌধুরী কলেজ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য হস্ত লিখিত পুঁথি, পুস্তক, সাময়িকীসহ ২,৫৬,৫২০ (দুই লক্ষ ছাপান্ন হাজার পাঁচশত বিশ) খানা বই রয়েছে এই কলেজের লাইব্রেরিতে।  শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ছাব্বিশ হাজার।

স্বাধীনতা উত্তরকাল হতে বর্তমান পর্যন্ত রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফলের ভিত্তিতে রাজশাহী কলেজের অবস্থান শীর্ষেই ছিল। এমনকি সারাদেশে সরকারি কলেজসমূহের মধ্যে রাজশাহী কলেজ ফলাফলের দিক থেকে তার শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ সারাদেশের কলেজসমূহের মধ্যে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে।

এছাড়াও জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালের জন্য বিবেচিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে মহামান্য প্রেসিডেণ্ট আবদুল হামিদের নিকট থেকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়াও এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ সম্মেলন-২০১৭ এ সরকারি কলেজের হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে মানসম্মত শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান তথা মডেল কলেজ হিসেবে রাজশাহী কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। রাজশাহী কলেজে অনন্য অবদানের জন্য বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান জাতীয় পর্যায়ে পাঁচটি পুরস্কার লাভ করেছেন। যা প্রমাণ করে বর্তমান রাজশাহী কলেজ শিক্ষাক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে চলেছে।

 


শর্টলিংকঃ