- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

হ্যাপি কোয়ারেন্টাইন


আমার বারান্দার গাছগুলোতে ফুল ফুটি ফুটি করছে।হাস্নাহেনা আর এলাম্যন্ডা।নজরুল এর “অভিবাসন” কি পড়েছেন কেউ? “বন্ধুরা,যে সওগাত আজ আপনারা আমার হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম”কেউ কেউ পড়েননি হয়তো কিন্তু শুনেছেন। জীবনের এক কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতা উনি সেখানে তুলে ধরেছেন। তার ছেলে শিশু সন্তান মারা গেছে। তীব্র মন খারাপ আর হতাশায় তার মন ডুবন্ত। এমন সময় হাস্নাহেনার তীব্র গন্ধে তিনি আপ্লূত হলেন, অভিভূত হলেন।

আবিষ্কার করলেন জীবনের এক নূতন দর্শন।আমারও এই গাছ দুটো র দিকে তাকিয়ে মনে হলো করোনার এই দুঃসহ সময়ে গাছেরা ঠিকই তাদের কাজ করে যাচ্ছে, ইদানীং পাখির শব্দে সকাল বেলায় কান ঝালাপালা হয়ে যায়। এরা আগেও ছিলো। মানুষ -জন কম বের হচ্ছে, গাড়ি নাই এই কারণে কি এরা বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে??তাহলে ইট-কাঠ দেয়ালের প্রতি তাদের কোন অসন্তোষ নেই হয়তো, মানুষ আর তার ব্যস্ততাই হচ্ছে তাদের শত্রু??

গত প্রায় তেরো দিন ধরে আমি গৃহবন্দী।আসলে তাও না।বলা চলে রুম বন্দী বা এক কামরাবন্দী। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর সরকারের নিয়ম অনুযায়ী এক কামরার জীবন বেছে নিয়েছি। প্রথমে মনে হয়েছিল কিভাবে কাটবে আমার দিন।গত ১৪ বছরেও সুস্থ অবস্থায় আমার টানা তিন দিন ঘরে বসে থাকার কোন রেকর্ড মনে করতে পারিনা।কিন্তু বিশ্বাস করুন ব্যাপারটা আমার কোন রকমেরই কষ্টকর মনে হয়নি।

কারণ আমি কয়েকটি ব্যাপার অনুসরণ করেছি।সচেতন ভাবে আমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম কোন ধরনের হতাশাবোধ বা মনখারাপ ভাবকে পাত্তাই দেবোনা।এ বলা চলে একটা প্রতিজ্ঞা র মতো।ব্রেনকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না যে আপনি এই মুহূর্তে অলস,আপনার তেমন কোন কাজ নাই বা আপনি শুধু আর কিছুই না -বের হওয়ার দিন গুনছেন।তাহলেই ব্রেন আপনাকে পেয়ে বসবে আর নাচাবে।এই হাহাকার ওই মন খারাপ, কত কিছু বাঁধাবে।তাই আসলে এই অবস্থাতেও সকাল বেলা থেকেই আগের নিয়ম মেনে চলতে চেষ্টা করেছি ।অর্থাৎ সাতটা, সাড়ে সাতটায় নিদেন পক্ষে আটটার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। যেই কাজগুলো আগে করতে পারতাম না বলে মনে হাহাকার হতো, দুঃখ লাগতো যেমন একটা তাড়াহুড়ো বিহীন শান্তিময় সকাল- সেরকমটা প্রতিদিন উপভোগ করেছি।

গাছে পানি দিতে দিতে পাখি দেখা,সবুজ গাছপালা দেখা,না হলে অন্তত এক কাপ চা নিজের জন্য নিজেই বানিয়ে খেয়েছি , গান শুনতে শুনতে উদাস হয়েছি আর রোদ মেখেছি হাতে পায়ে গায়ে।জানেন তো শুধু ঢাকা শহর না এমনকি বাংলাদেশের গ্রামের মাহিলাদের মাঝেও ভিটামিন ডি এর খুব অভাব একেবারে হরহামেশাই। আর এর জন্য বিভিন্নরকম গায়ে ব্যাথা,হতাশা,দূর্বলতার রোগী সব ঘরে ঘরে।ব্যায়ামের কথা বললে অনেকেই হাসবেন জানি। তারপরও একটুখানি চেষ্টা করে দেখুন না।

ইদানীং, না করলে আমার গা এমন ব্যাথা হয়!) বা স্ট্রেচিং এ আরাম ও লাগে সাথে মনে আর শরীরে ফুরফুরে ভাবও আসে। ব্যাপার টা হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ে আমরা যেমন হাটাচলার মধ্যে থাকি সেরকমের অভ্যাস টা রেখে দিতে হবে।ইউটিউব ভর্তি কত এক্সারসাইজ, কত ডায়েটিং আইডিয়া।যেটা আপনার ভালো লাগে, বোরিং লাগে না ফলো করতে পারেন।এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। লকডাউন উঠে গেলেও যাতে অভ্যাস বজায় রাখা যায় এরকম একটা গ্রহণযোগ্য শিডিউল মনে সেট করে রাখলে আখেরে নিজের উপকার সবাচাইতে বেশি।

আমি ভেবে দেখেছি শুধু নিজের জন্য না , এর পাশাপাশি আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যও একটি রুটিন তৈরি করে দিতে হবে।ব্যাপার টা একটা মজার খেলার আকারেও নেয়া যেতে পারে। বাবুটা যদি ছোট ও থাকে তাকেও নিজে নিজে একটা রুটিন করার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। যেখানে তার পড়ার পাশাপাশি, গল্পের বই, খেলার নির্দিষ্ট সময় থাকবে। সবশেষে সবাই মিলে একটা ফ্যমিলি টাইম উপভোগের বিষয় থাকতে পারে।সেটা একটা মজার নাটক বা সিনেমা এক সাথে দেখাও হতে পারে বা মজার কোন আইটেম রান্না করা কিংবা এলবাম গোছানো অথবা বাড়িঘর এর একটা একটা করে একেক ঘরের আসবাবপত্র এর সাজসজ্জা পরিবর্তন ।

অফিস ওয়ার্ক যারা করেন, তাদের ক্ষেত্রে পুরো বাড়ির একটা কোনো কর্ণার আপনি নির্বাচন করে নিতে পারেন আপনার কাজের স্থান হিসেবে। আপনার যদি “ওয়ার্ক ফ্রম হোম সিস্টেেম” থাকে তাহলে তো খুবই ভালো সকালে একটা গ্রুপ কল করে সবাই যে যার মতো দিনের কাজ ভাগ করে নিলেন। আর যদি তা নাও থাকে সকালে সারাদিন এর একটা কাজের তালিকা করে ফেলা ভালো। সেটা লিখিত আকারে হলে ভালো। দিনের যে কোন সময় কলিগদের সাথে আরো দু একবার কথা বলে নেয়া আপনাকে কাজের পরিবেশ টা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

আর যদি তেমন কোন অফিস নাই থাকে, আপনি অন্য কোন কিছু ও করতে পারেন।সেটা আপনার জীবনের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে,কাজ সংক্রান্ত কোন স্কিল বা দক্ষতা বাড়ানো ট্রিকস আয়ত্ত্ব করা হতে পারে কিংবা আপনার কোন পছন্দসই বিষয় ধরে নিয়মিত জ্ঞান অর্জন হতে পারে। আর আত্মীয় স্বজনদের বা বন্ধু বান্ধবের সাথে নিয়মিত ফোনালাপ ও কিন্তু স্ট্রেস কমায়।

একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি আপনাদের সাথে আমার আজকের এই সকালের।আমার বাগানের গাছদের কথা বলছিলাম।ফুল ফুটানো এই দুই গাছের পাশের অন্য একটা পাতাবাহার গাছের কথা ।আসার পরদিন সকালে বেলায় ঘরের বারান্দার গাছগুলোতে পানি দেয়ার সময় থেকেই দেখছি, সে একটু নির্জীব।প্রথমে ভাবলাম পানি বোধহয় কম পেয়েছে, ইদানিং যা রোদ পড়েছে। ৩/৪ দিন পানি বেশি দেয়ার পরও দেখি উন্নতি নাই। এক পাশের একটি গাছ(ওই টবে একসাথে তিনটা গাছ লাগানো ছিলো, তার একটা) একটু একটু আলগা।আমি একটা কলম দিয়ে ওই অংশের আরো কিছুটা মাটি আলগা করে অই গাছ এর গোড়া ঢেকে দিয়ে এক ধরনের মনোতুষ্টি পেলাম যে আহ,আমি ভাগ্যিস খেয়াল করেছি।কিন্তু প্রতিদিন ই পানি দিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি কি রে এটার উন্নতি হয় না কেন?

আজ ১২ তম দিন।বারান্দা ভাসানো রোদ এর তেজে এই গাছটিকে দেখে মনে হলো Something is wrong with her.আমার হাজবেন্ড এর কাছ থেকে ছুরি, কাঁচি চেয়ে নিলাম।এরপর গাছের গোড়ায় একটা চাড় দিয়ে দেখলাম যে কোন দরকার ই নাই,সে অলরেডি বিচ্ছিন্ন।মানে এতো লম্বা বড় হয়ে গেছে আমার যে গাছ তার গোড়ায় বলতে গেলে মাটি নাই ই।কোন রকমে ধুকপুক করে সে বেচে আছে আর এক একটা দিন একটা -আধটা করে পাতা মরছে,একটু নজর দিয়ে দেখলেই কেবল বুঝতে পারবেন তার পাতাগুলোতে প্রানশক্তি কম। আমি গাছগুলো

তার পাতাগুলোতে প্রানশক্তি কম। আমি গাছগুলো সরিয়ে নিয়ে টবের মাটি গুলো ভাংতে লাগলাম।এতো অবাক লাগছিলো যে আমার এই টবভর্তি মাটি তার মধ্যে অজস্র শেকড় ছড়িয়ে আছে পুরো টা জুড়ে একেবারে নিচ পর্যন্ত।এতো নিশ্চিত করে ছিলো সে জীবন যে, তার রস সংগ্রহ করতে কোন সমস্যাই যেন না হয় -তাহলে কেন সে এমন বিচ্ছিন্ন হলো!!আরও একটু পর তার জবাব পাওয়া গেলো। অসংখ্য পিঁপড়া বাসা বেঁধেছে এই মাটিতে আর অজস্র তার ডিম।এরাই বোধ হয় শেকড় কাটার কাজটা করেছে।এখন কি করা যায়। খুবই ই লজ্জা লাগছে বলতে যে এখন পর্যন্ত অনেক বারই বাগান করার চেষ্টা করেছি অনেক বছর ধরে, বলা চলে ছোট বেলা থেকেই। কিন্তু জ্ঞান আমার খুবই নগন্য।

আমার মা যতটুকু শিখিয়েছিলো, দুইবেলা গাছে পানি দিতে হয়,মাসে দু একবার মাটির গোড়া আলগাভাবে করে দিতে হয় যাতে অক্সিজেন ঢুকে, মাসে একবার গোবর বা ব্যবহৃত চাপাতা গাছের গোড়ায় দেয়া।গাছ বেশি বড় হলে পরে এর মাথাগুলো কেটে দেয়া।যাতে ঝাকড়া হয়।কি লজ্জার বিষয় বলুন তো, আমার মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষের জীবনের এরকম সাধারণ একটা কাজে, জ্ঞান এর এতো করুণ অবস্থা কেন বলুন তো??

আমার পুত্র তাহলে এতোটুকুই শিখবে আমার কাছ থেকে!!!হায় হায় মানুষের জীবন এ মা এর এতো বড় ভূমিকা??আরো মনে হলো সারাজীবন আমরা কতকিছু নিয়ে পড়াশোনা করি,কিন্তু কতজন আমরা জীবন যাপনের কৌশল গুলো নিয়ে ভাবি,ভালো থাকতে হলে পরিবারের সবার মধ্যে ভালো সম্পর্কের কি দরকার কিংবা কিভাবে করা যায় সেটা নিয়ে জানার বা শেখার চেষ্টা করি।আসলে জীবন যাপনের জ্ঞান বলতে আমরা আশেপাশে শিশুকাল থেকে দেখেছি যা তাই অবচেতনে আমাদের মধ্যে যতখানি বাসা বাঁধে।

এর বাইরে আমরা যদি কোন সম্পর্কে হঠাৎ কোন সমস্যায় পড়ি, এর ওর কাছে যতখানি জানার বা জ্ঞান নেয়ার চেষ্টা করি।আমরা আমাদের মনের যত্ন নেয়া বিষয়টিকে অবজ্ঞা কই,মনের অসুখ কে অযোগ্যতা মনে করে লুকিয়ে রাখি।আমার প্রচন্ডরকম ভাবে মনে হলো এইরকম নিজের, নিজের কাছে র লোকদের অবহেলায় আমার বা আপনার জীবন ও কিন্তু একসময় শেকড় বিচ্ছিন্ন গাছের মতো হতে পারে।এবং আসুন না, হাতের সামনেই আপনার মোবাইল ফোন,ইন্টারনেট। এগুলো নিয়েও একটু ঘেঁটে পরিক্ষীত কোন সাইট থেকে জীবন যাপনের কৌশল গুলো জানি। চমৎকার সময় কাটার পাশাপাশি স্ট্রেস কে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়, সেই জ্ঞানটিও চর্চ্চা করে ফেলি।

আর হ্যা, খাবারের মধ্যে লেবু,শাক সবজি র আধিক্য রাখবেন।প্রচুর পানি খান না হলে কোষ্ঠ্যকাঠিন্যের সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।প্রয়োজনে প্রতিদিনই ইসবগুলের ভুষি খান,শশা খান।রাত আটটার পর আর মোবাইল /টিভি/মুভি কিছুই দেখবেন না।এইসব আপনার রাতের ঘুম কে নষ্ট করবে।১১টার মধ্যে অবশ্যই শুভরাত্রি।

এতো সাবধানতার পরেও মন খারাপটা কোন এক চোরাগলি দিয়ে কিন্তু ঢুকে যেতে পারে,ভজঘট পাকিয়ে দিতে পারে আপনার সময়। এমন অদ্ভুত এক অনিশ্চিত অনুভূতি আপনাকে অসার করে দিতে পারে।এই অদ্ভুত সময়ে হয়তো এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু কখনই একে টানা যাবেনা বা ধরে রাখা যাবেনা।আশা করি ঘরে থেকেও আপনারা জীবনের অন্য রকম নতুন এক ছন্দ ফিরে পাবেন।হ্যাপি কোয়ারান্টাইন।

 

লেখক : ডা. শরমিন আক্তার সুমি 

সহকারী অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগ,
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড সার্জারি, ঢাকা।