৩৬ বছর ধরে রাবিতে পুরোনো বই বেঁচছেন সম্রাট


সুব্রত গাইন, রাবি:

স্বপ্ন ছিল লেখাপড়ে করে বড় চাকরি করার। আর্থিক অনটনের কারণে তা সম্ভব হয়নি। কোনো রকম টেনেটুনে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। সপ্তম শ্রেণিতে যাওয়ার আগেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। যাতে করে পড়ালেখা আর বেশি দূর গড়ায়নি তার। তারপরও দমে যাননি, এখনও আছেন বইয়ের সাথে। পুরানো বই নিয়ে প্রতিনিয়তই চলে তার পড়াশুনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা বিভাগের বইয়ের নামই প্রায় তাঁর মুখস্ত।

বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) পুরানো বইয়ের দোকানি তাইজুল ইসলামের কথা। যদিও ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ‘সম্রাট মামা’ হিসেবে পরিচিত তাইজুল। ১৯৮৩ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের পুরানো প্রয়োজনীয় বইয়ের যোগান দিয়ে ক্যাম্পাসে ব্যবসা করে আসছেন তিনি। নিজেও বই পড়েন এবং এলাকার শিশুদেরও পড়ান।

রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা হররোজ সকাল আটটা বাজলেই চলে আসেন ক্যাম্পাসে। ভ্যানে করে পুরানো বই নিয়ে হাজির হন সময় মতো। একচালা ঘরে থরে থরে সাজিয়ে বিক্রি করেন পুরানো বই। আবার আড়াইটা বাজলেই বই গুছিয়ে তুলে নে ভ্যানে। গন্তব্য নিজ বাড়ি। এভাবেই ৩৬ বছর ধরে পুরানো বই বিক্রি করে আসছেন তাইজুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটি পুরানো বইয়ের দোকান আছে । এর মধ্যে তাইজুল ইসলামের দোকান সবচেয়ে পুরানো। তাঁর পাশে ঈমান খান নামে আরেকজন বই বিক্রেতা রয়েছেন। তিনিও ১৯৯০ সাল থেকে বই বিক্রি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরের পাশে তাদের দু’জনের দোকান। তাইজুল আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন বাজারেও পুরানো বই বিক্রি করতেন। তবে বয়সের ভারে তা আর করা হয় না তার।

তাইজুলের বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্টেশন বাজারের মেহেরচন্ডী এলাকায়। আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখা হয়নি তার।  পরে কিছু সময় বিভিন্ন নামীদামী হোটেল ও রেস্তোরায় কাজ করেছেন তিনি।  নিজের পড়ালেখা করার সুযোগ না হলেও একমাত্র মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যায়ের জিওলজি অ্যান্ড মাইনিং বিভাগ থেকে তার মেয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন।

পুরানো বইয়ের দোকানি হিসেবে পরিচিত হওয়ার পিছনে রয়েছে অনেক কথা। জানতে চাইলে তিনি গল্প জুড়ে দেন। জানান, বেকার থাকা অবস্থায় সাহেব বাজারের একটি বইয়ের দোকানে বসে ছিলেন ঘন্টা খানেক। সেখানে প্রচুর নতুন বই বিক্রি হতে দেখে নিজেই চিন্তা করলেন পুরান বই সংগ্রহ করে বিক্রি করলে কেমন হবে?

এই চিন্তা থেকেই বিভিন্ন দোকান থেকে পুরানো বই ও পত্রিকা সংগ্রহ করে আনতেন তিনি। পরে এগুলো নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রাম্যমান পুরানো বইয়ের দোকান দিয়ে বসেন। প্রথম দিকে টুকটাক দুই টাকা, পাঁচ, দশ টাকা বিক্রি হতো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করে বড় আকারে দোকান নিয়ে বসেন।

ওই সময় পুরানো বইগুলো দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীরাও সহযোগিতা করেছিলো বলে জানান তিনি। এরপর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে তার পুরানো বইয়ের ব্যবসাটা শিখতে। এখনও অনেক শিক্ষার্থী বই দেয় তবে তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা দিয়ে কিনতে হয়। আবার ওই শিক্ষার্থীরাই তার কাছে থেকে বই কিনে।

তাইজুল বলেন, ‘শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বই কিনেন না পাশাপাশি শিক্ষকরাও পুরানো বই কিনেন। আমি দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন’শ শিক্ষক আছেন যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়েছেন। তারাই আমার কাছে থেকে বেশি বই কিনেন।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, একচালা ছাউনির দোকানটিতে নানা ধরণের পুরানো বই রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরণের উপন্যাস, গল্প, কবিতা, মনীষীদের জীবনী, ধর্মীয়গ্রন্থ, বিভিন্ন একাডেমিক বই। এছাড়া বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষ ধরণের বই। যেমন- বাংলা, ইংরেজি, গনিত, বিজ্ঞান, রসায়ন, সাধারণ জ্ঞানের বই সংগ্রহ করে বিক্রি করে।

তবে বেশির ভাগ বই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিভাগের। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি বই আছে। যার বেশির ভাগ বইয়ের দাম ৪০টাকা, ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত আছে।

তবে ইচ্ছে করে তাইজুল এই পেশায় আসেননি। তারাও ইচ্ছা ছিল বড় কিছু করার। করতে চেয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-খাটো কোনো চাকুরি; তাও মেলেনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়ন, গার্ড, মালির চাকুরির জন্য অন্তত পক্ষে ১০ বার ইন্টারভিউ দিয়েছি। ইন্টারভিউয়ে পাশও করেছি কিন্তু আমাকে চাকুরিতে নেয়নি। চাকুরি না হওয়ায় অনেকদিন বেকার ছিলাম। তার পর এখানে পুরানো বইয়ের দোকান নিয়ে বসেছি।’

তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩৬ বছর ধরেই বই বিক্রি করছি। এই ৩৬ বছরে অন্তত পঁচিশ বার প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি দোকান করার অনুমতি জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে পুরানো বইয়ের দোকান দিলে পরিবেশ নষ্ট হবে।

তখন তাঁরা অনুমতি দেয়নি। এজন্য অন্য কোনো বইয়ের দোকান বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। কেননা অস্থায়ী দোকান যেকোনো সময় তুলে দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ’

পুরানো বই কিনতে আসা এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুযায়ী আমাদের এখানে বইয়ের দোকান কম। অধিকাংশ বই কিনতে যাওয়া লাগে শহরের বইয়ের দোকানগুলোতে। কিন্তু একটা চায়ের দোকান, সিগারেটের দোকান এমনকি কাপড়ের দোকানের ছড়াছড়ি। কিন্তু একটা ভাল বইয়ের দোকান বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। তবে পুরানো বইয়ের দোকানটা থাকায় আমরা অল্প টাকায় প্রয়োজনীয় বইগুলো কিনতে পারি।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার রানা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক বইয়ের দোকান নেই বললেই চলে। যার জন্য শিক্ষার্থীরা তেমন বই পড়ে না। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্রাম্যমান বইয়ের দোকান থাকতো; তাহলেও শিক্ষার্থীরা বই না কিনলেও একবার খুলে দেখতো।

তিনি আরও বলেন, আবার দোকানগুলো ভ্রাম্যমান হলে সমস্যায়ও পড়তে হয়। তার কারণ রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের মধ্যে বাইরে বইয়ের দোকান দেওয়া সম্ভবও নয়। একটা ঘরের মধ্যে যদি এমন বইয়ের দোকানগুলো করার ব্যবস্থা করতো তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং দোকানিরাও সুবিধা পেতো। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এবং প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

তারপরও এমন জ্ঞান পিপাসু মানুষ থাকায় আজও জ্ঞানের ফেরিওয়ালার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের ভালবাসার টানে ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পুরানো বই নিয়ে হাজির হচ্ছেন ক্যাম্পাসে। এ যেনো অন্য এক ভালবাসার টান।

অন্যকে শিক্ষিত করার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সম্মানের সহিত। নিজে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে না পারলেও শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৬ বছর ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন পুরানো বইয়ের দোকানি তাইজুল ইসলাম ওরফে সম্রাট মামা!


শর্টলিংকঃ