৪লাখ টাকায় মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে ধ্রুমজাল


মাহাবুব হোসেন, নাটোর:
নাটোরে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে চার লাখ টাকার বিনিময়ে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে তৈরী হয়েছে ধ্রুমজাল। তবে সঠিক কারণ অনুসন্ধানে এরি মধ্যে মাঠে নেমেছে সরকারী গোয়েণ্দা সংস্থা। অভিযুক্ত কর্মকর্তার দাবী, টাকার বিনিময়ে কোন মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ২৩ আগষ্ট গোপন সংবাদের ভিত্তিতে লালপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ধরবীলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এজন্য নাটোর জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি বিশেষ টহল টিম গঠন করে। টিমে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরির্দশক লাল মাহমুদ তালুকদার, সহকারী উপ-পরিদর্শক জামালুর রহমান, সিপাহী আ.ন.ম হাসান, মোহাম্মাদ শহিদুল ইসলাম ও সিপাহী নিজাম উদ্দিন অভিযান পরিচালনা করেন।

এসময় খলিলের মোড়ে পাঁকা ব্রীজের ওপর দিঘা বাজার দিয়ে বড়বাড়িয়া যাওয়ার পথে নীল রংঙের সিএনজি চালিত অটো রিক্সায় তল্লাশি চালায় তারা। এসময় সিএনজি চালকের বাম পাশে বিশেষ কায়দায় প্লাস্টিকের বস্তার ভিতর ১৬০বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে চালক নাজমুল হককে আটক করে তারা। ১৬০ বোতল ফেন্সিডিলের যার আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে দুই লাখ টাকা।

পরে সিএনজি সহ নাজমুল হককে লালপুর থানায় হস্তান্তর করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মামলায় ধরবিলা পশ্চিমপাড়ার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে শাকিল ইসলাম এবং সামছুল ইসলামের ছেলে সামিউল ইসলামকে সাক্ষী করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে, এই দুই সাক্ষীর উপস্থিতিতে পুরো অভিযান চালানো হয়েছে।

অভিযানের ওই দিনই উপ-পরির্দশক লাল মাহমুদ তালুকদার বাদী হয়ে লালপুর থানায় নাজমুল হকের নামে একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং ২৮। মামলায় লালপুর থানা পুলিশ আদালতের মাধ্যমে নাজমুল হককে জেল হাজতে প্রেরণ করে।

তবে মামলার প্রত্যেক্ষ দুই সাক্ষী মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, হুমকি-ধামকি দিয়ে তাদের কে সাক্ষী বানানো হয়েছে। জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার সাক্ষী সামছুল ইসলামের ছেলে সামিউল ইসলাম বলেন, অভিযানের সময় তারা পাশেই ছিলেন। এসময় দুইজনকে ১৬০বোতল ফেন্সিডিল এবং ২হাজার পিচ ইয়াবা সহ তাদের গ্রেফতার করা হয়। পরে মাদক দ্রব্যের লোকজন ধমক দিয়ে একটা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে। পাশাপাশি মোবাইল নম্বর নিয়ে চলে যায়। এরপর কত বোতল ফেন্সিডিল দিয়ে চালান দেওয়া হয়েছে আমরা সে বিষয়ে কিছুই জানি না।

তবে সঅনুসন্ধানে জানা যায়, দিঘা বাজার দিয়ে বড়বাড়িয়া যাওয়ার পথে নীল রংঙের সিএনজিতে ছিলেন পার্শ্ববর্তী বাঘা উপজেলার আলাইপুর গ্রামের মোহসিন আলীর ছেলে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আব্দুল বারী এবং অটো রিক্সার চালক নাজমুল হক। মুলত অভিযানে ৪০০বোতল ফেনসিডিল এবং দুই হাজার পিচ ইয়াবা সহ তাদের আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

এসময় আব্দুল বারীর ফোনে (ফোন নম্বরটি এই প্রতিবেদকের সংগ্রহে রয়েছে) বাঘা উপজেলার এক গণমাধ্যম কর্মী ফোন দিলে অভিযানে থাকা লাল মাহমুদ তালুকদার মাদক ব্যবসায়ী আব্দুল বারীকে আটক করে লালপুর থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা জানান। এরপর থেকে গণমাধ্যম কর্মীরা ওই ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

অনুসন্ধানে আরও যানা যায়, বিভিন্ন থানায় চারটি মাদক মামলার আসামী শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আব্দুল বারী কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চার লাখ টাকায় রফাদফা করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাৎক্ষনিক ভাবে আব্দুল বারী একজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে চার লাখ টাকা তুলে দেয় অভিযানে থাকা কর্মকর্তাদের হাতে। পরে আব্দুল বারীকে ছেড়ে দেয় তারা।

আর মাত্র ১৬০বোতল ফেনসিডিল দিয়ে লালপুর থানায় হস্তান্তর করা হয় চালক নাজমুল হক কে। গ্রেফতারকৃত নাজমুল হক বাঘা উপজেলার হরিরামপুর গ্রামের নূর মোহাম্মদ এর ছেলে। বর্তমানে তিনি নাটোর কারাগারে রয়েছে।

অভিযানের সময় প্রত্যেক্ষদর্শী কলেজ শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, প্রথমে মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশি করে। এসময় একটি সিএনজি আসলে সেখানে তল্লাশি চালায় তারা। সেখানে মাদক ব্যবসায়ী আব্দুল বারী সহ সিএনজি চালককে আটক করা হয়। এসময় টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য দফারফা করতে দেখা গেছে। পরে টাকা নিয়ে লালপুর থানায় দেখা করতে বলে তারা। এরপর কি হয়েছে আর বিষয়টি জানা নেই।

এদিকে, অভিযানে টাকার বিনিময়ে মাদক মামলার আসামীকে ছেড়ে দেওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। বর্তমানে ঘটনাটি সবার মুখে মুখে। অনেকে আসামীদের ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন। তবে সঠিক কারণ অনুসন্ধানে এরি মধ্যে মাঠে নেমেছে সরকারী গোয়েণ্দা সংস্থা।

অভিযুক্ত এবং অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক লাল মাহমুদ তালুকদার দাবী করে বলেন, অভিযানের দিন সিএনজি চালক কে ১৬০বোতল ফেনসিডিল সহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এসময় সিএনজি চালক নিজেই ছিলেন। চালক নাজমুল হক খুবই দুধর্ষ, তার কাছে চাকুও ছিল। সে যে কোন মুহুর্তে আমাদের জখম করে দিতে পারতো। তবে কোন ইয়াবা পাওয়া যায়নি। আর টাকার বিনিময়ে কোন মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।তবে মামলার এজাহারে কোথাও চাকু উদ্ধারের কথা লেখা হয়নি।

টাকার বিনিময়ে কেন আসামী ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে এমন প্রশ্নে লাল মাহমুদ বলেন, আমরা জীবন বাজি রেখে কাজ করি, এই ধরনের অভিযোগ আসলে খারাপ লাগে। কাজ করার মন মানসিকতা থাকে না। যেহেতু মাদক নিয়ে কাজ করি, সে কারণে স্বাভাবিক ভাবে অভিযোগ উঠতেই পারে।

নাটোর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, প্রথমে বিষয়টি আমরাও শুনেছিলাম। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। তবে ইয়াবা উদ্ধারে জন্য পরের দিন আবারো লালপুর থানায় অফিসার পাঠানো হয়। কিন্তু কোন ইয়াবা পাওয়া যায়নি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে একজন উপ-পরিদর্শক মামলার তদন্ত করছে।


শর্টলিংকঃ