‘‌নিস্করুণ প্রেমহীনতার প্রতিবাদ রাবির নীহার বানু’


হাসান আদিব :

একপাক্ষিক প্রেম। অন্য পক্ষের তীব্র বিরোধ বা অমত। মানসিক অস্বস্তি। একপক্ষের সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়। অন্য পক্ষের লালসা পূরণের তীব্র মোহ ও আকাঙ্খা। এই মোহ ও আকাঙ্খা কোনো কোনো সময়ে মানুষকে পশুতে পরিণত করে। তখন মানুষরুপী ওইসব পশুরা কোন অপরাধকেই অপরাধ মনে করে না। লোমহর্ষকতা, নির্মমতা কোনটিই তাদেরকে স্পর্শ করে না। সমাজে অশান্তি হানাহানি সবই ঘটে থাকে এধরণের ঘটনা থেকে।

সুন্দরী নীহার বানুকে পুঁতে রেখেছিল ওরা

ঠিক তেমনই এক ঘটনা ঘটে ১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। ঘটনাস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এক অন্ধ একপেশে প্রেমিক ক্ষুব্ধ হয়ে খুন করে তার সহপাঠী এক ছাত্রীকে। স্বাধীনতাত্তোর দেশের সর্ব্বোচ্চ একটি বিদ্যাপিঠে এধরণের ঘটনা মানুষকে বাকরুদ্ধ করে তুলেছিল। আলোড়িত করেছিল সমাজের মানুষকে। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘদিন পর পুঁতে রাখা ফুটফুটে মেয়েটির কঙ্কালসার দেহ উদ্ধারের ছবি খবরের কাগজে প্রকাশের পর বেদনাহত মানুষের করুণ দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। চাঞ্চল্যকর নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের ৪৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ।

যেভাবে ঘটনার শুরু:

১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি, সেদিন ছিল মঙ্গলবার। কুয়াশার চাঁদরে মোড়া শীতের সকাল। সন্তর্পণে নাস্তা সেরে বাসা থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চেপে ক্যাম্পাসে এসেছিল মেয়েটি। পরণে খয়েরি রঙের শাড়ি, সঙ্গে হলুদ ব্লাউজ। তার উপরে হাতে ডিজাইন করা নীল পশমী কোট, পায়ে লাল সবুজের কারুকাজ করা হাইহিল। কালো কেশের দীর্ঘ বেণী। এককথায় অপরুপ সৌন্দর্যের এক সমাহার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ হয় দুপুরে। ক্লাস শেষ হলে বাসায় ফেরার পালা। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল, গোধুলী শেষে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। তবুও ঘরে ফেরেনা মেয়েটি। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারানো বিধবা মায়ের মনে তাই উঁকি দেয় দুশ্চিন্তা। তাকিয়ে থাকে ভার্সিটির বাস থেকে নেমে পায়ে চলা যে পথে প্রতিদিন ফেরে মেয়েটি। এই বুঝি এল! এখনকার মত মোবাইলে যোগাযোগের যুগও নয়; যে ঝট করে ফোন করে জেনে নিবে মেয়ে কোথায়। অজানা আশঙ্কায় দুশ্চিন্তা ভারী হয় মায়ের মনে।

এমতাবস্থায় পেশায় চিকিৎসক বড় মেয়েটি ফেরে বাসায়। দুশ্চিন্তা মাখা মায়ের মুখ দেখে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরা বড় মেয়েটি। তার আগে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা জানায়, ‘ও এখনো বাসায় ফেরেনি!’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে বড় মেয়ে বলে, ‘বলো কি মা’!

নীহার বানুর শহিদ বাবা
নীহার বানুর শহিদ বাবা

সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে মনে ভীড় করা নানা আশঙ্কাকে মায়ের সামনে আড়াল করে ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহরে। ছোট বোনে সহপাঠী, পরিচিত অন্য শিক্ষার্থী, এমনকি বাসে যাওয়া আসা করে যাদের সঙ্গে তাদের কাছে খোঁজ নিয়ে অজানা দুর্ঘটনা মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরে বড় বোন। খোঁজ নেন থানায় ও হাসপাতালেও। কিন্তু কোন হদিস মেলে না। পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে খোঁজ পাওয়ার অনিশ্চিত আশা নিয়ে রাত পার করে পরিবারের সবাই। শঙ্কা, উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ভোরের অপেক্ষা শেষ হতে চাই না! এ যেন ৭১’ যেদিন পাক হানাদার বাহিনী তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় সেদিনের রাতের মত দুর্বিষহ দমবন্ধ করা কাল রাত্রি!

পরদিন আশা-নিরাশার দোলাচালে পরিবারের সদস্যরা ক্যাম্পাসে এলেন খুঁজতে। ক্লাস, মেয়েদের আবাসিক হল, বিভাগের সভাপতি, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর দপ্তর কোন খানেই নেই সদা চঞ্চল মেয়েটি। হাজিরা খাতায় আগের দিন ক্লাসে উপস্থিত হওয়া নিশ্চিত করলো। এমনকি কেউ কেউ জানালো, গতকাল দুপুরের দিকে রিকশা করে শহরের দিকে যেতে দেখেছে মেয়েটিকে। অথচ আজ কোন হদিসই নেই মেয়েটির! এই ছিলো চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নীহার বানু সম্পর্কে জীবিত অবস্থায় শেষ দিনের সবশেষ খোঁজ।

নীহারের নিখোঁজকে সহপাঠীরা শুভ হিসেবে নিয়েছিল। কারণ একই সঙ্গে নীহারের ঘনিষ্ঠ ছেলে সহপাঠী আহমদ হোসেন বাবুও নিখোঁজ হয়। সবার ধারণা ছিল, নীহার তার সহপাঠী বাবুর সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তাই ক্যাম্পাসে রটে গেল ‘নীহার-বাবুর শুভ বিবাহের’ গুজব! কিন্তু আকস্মিকভাবে তিনদিন পর ২৯ জানুয়ারি ক্লাসে দেখা মেলে বাবুর। কিন্তু নীহার কোথায়!!

শোরগোল পড়ে যায় চারিদিকে। পরিবারের অনুরোধে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বিভাগের সভাপতি চেম্বারে ডাকে সহপাঠী বাবুকে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাবু ছোটে লতিফ হলে নিজ কক্ষের দিকে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটি সুটকেসে নিয়ে উধাও হয় বাবু। আজও ক্যাম্পাসে ফেরেনি রংপুরের বানিয়াটারী গ্রামের আবেদ আলীর ছেলে আহমদ হোসেন বাবু!

রহস্য উদঘাটন :

সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা
সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা

হাতের কনুইয়ে ক্ষত। যুবকটি চিকিৎসককে জানায়, কুকুরের কামড়ে ক্ষত হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞ চিকিৎসক ক্ষত দেখে বুঝলেন কুকুরের নয়, মানুষের কামড়! তার কাছে গোপন রেখে পুলিশে খবর দেয় ওই চিকিৎসক। পুলিশ পাকড়াও করে এনামুল হক নামের ওই যুবককে। জিজ্ঞাসাবাদে সে দিতে থাকে ওই ঘটনার নানা তথ্য। একপর্যায়ে ১৯৭৬ সালে ১২ জুন সেতু পুলিশকে নিয়ে যায় মীনা মঞ্জিলে।

ওই বাড়ির দক্ষিণ দেয়ালে সঙ্গে টয়লেটের সামনে খালি উঠানের কোণে সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা একটি জায়গা দেখা যায়। সেদিকেই আঙুল উঁচিয়ে সে দেখিয়ে দেয় পুলিশকে। জায়গাটা খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে টিনের একটি ট্রাঙ্ক। সেটি খুলতেই সবাই স্তম্ভিত, হতবাক! পুলিশের এক কর্মকর্তা চিৎকার করে ওঠেন, ‘আরে! এ তো নীহার বানু মনে হচ্ছে।’

নিখোঁজের প্রায় ৬ মাস পর এভাবেই ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে সবকিছু। পরে ওই মামলার রাজসাক্ষী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ এনামুল হক মীনা মঞ্জিলে এই হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা। বর্ণনাতে উঠে আসে, হত্যাকা-ের আগের দিন ২৬ জানুয়ারি নীহারের সহপাঠী আহমদ হোসেন বাবুর কক্ষে তার বন্ধুরা কয়েক বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করে। নীহারকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হবে। যদি সে রাজি না হয় জোর করবে। তবুও রাজি না হলে শেষ করে দিবে।

ঘটনার দিন আত্মীয়ের বাসায় নিমন্ত্রণ খাবার নাম করে নীহারকে মীনা মঞ্জিলে নিয়ে যায় তারই সহপাঠী আহমদ হোসেন বাবু। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন মোহাম্মদ এনামুল হক, আহসানুল হক, শহীদুল ইসলাম নীলু। আলাদা রিকশায় চেপে মীনা মঞ্জিলে পৌছায় বাবু আর নীহার। বাসায় ঢুকে সবাই বাবু ও তার বন্ধুরা এক হয়ে নীহারকে বিয়েতে রাজি হতে বলে। নীহার কিছুতেই রাজি হয় না।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাড়ি দিয়ে বাবু নীহারের গলা পেচিয়ে ধরে এবং রাজি হওয়ার জন্য চাপ দেয়। তাতেও রাজি না হলে অন্যরা নীহারের হাত চেপে ধরে আর বাবু শাড়ির পেচ আরো শক্ত করে। একপর্যায়ে নীহারের নাক ও মুখ দিয়ে হালকা রক্ত বের হয়। মৃত্যু নিশ্চিতের পর তারা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিনে মিটিং করে লাশ পুতে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় আজিজুর নামে আরেক বন্ধু তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এছাড়া ওই বাড়ির কেয়ারট্যাকার রুহুল আমিন ফেতুও তাদের সঙ্গে লাশ গুমে সহযোগীতা করেন।

হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ:

সাংবাদিক আহমেদ শফিউদ্দিন, যার প্রতিবেদনে খুলেছিলো রহস্যের জট
সাংবাদিক আহমেদ শফিউদ্দিন, যার প্রতিবেদনে খুলেছিলো রহস্যের জট

এরই মধ্যে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের এই খবর দেশে ছড়িয়ে যায়। দাবি ওঠে সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। হত্যার দেড় বছর পর ১৯৭৭ সালের ১৮ জুলাই বগুড়া মহাকুমা প্রশাসকের এজলাশে ৭ নং বিশেষ সামরিক আদলতে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। রাজশাহী সদর মহাকুমা হাকিমের কোর্ট থেকে মামলাটি উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বিশেষ সামরিক আদালতে স্থান্তারিত হয়। যার নম্বর ছিল : এম এল ৮৩/৭৭ এবং জি আর ১৩০/৭৬। তৎকালীন সময়ে ‘নীহার হত্যা মামলা’ বলে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠা ওই মামলার নথিপত্র ছিল ‘সরকার বনাম আহমদ হোসেন বাবু ও অপর পাঁচ আসামী’।

চার্জশিটে অভিযুক্ত আসামীদের পরিচয় ছিল, ১. আহমদ হোসেন ওরফে বাবু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র, বাড়ি : রংপুরের গংগাচড়া থানার বানিয়াটারী গ্রামে, পিতা: মো. আবেদ আলী)। ২. মো. আহসানুল হক (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র) ৩. কহীদুল ইসলাম ওরফে নীলু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র) ৪. মো. এনামুল হক (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতী বর্ষের ছাত্র) ৫. ওুহুল আমিন ওরফে ফেতু (মীনা মঞ্জিলের কেয়ারটেকার) ৬. আজিজুর রহমান ওরফে আজু (রাজশাহী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র) ৭. ওয়াহেদুল ইসলাম (বি.এ পাশ গ্রজুয়েট)। এদিন পলাতক আসামীদেরকে আদলতে হাজির হওয়ার নির্দেশনা দেয়া ছিল। এছাড়া মামলার ২৯ জন স্বাক্ষীকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করা হয়।

এামলায় সরকারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর ফজলুল করিম। তাকে সাহায্য করে তৎকালীন অতিরিক্ত পিপি এএস বারী। এছাড়া সিআইডির প্রসিকিউটিং ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ আলী পিপিকে সাহায্যের জন্য উপস্থিত থাকতেন।

সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা
সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা

আর আসামী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করেন ৬ জন আইনজীবী। তারা হলেন, মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত আর্ন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, এনায়েত ফজলুর রশিদ, মনিরুল ইসলাম, সাজ্জাদুল হক, রেজাউল করিম মিন্টু, আব্দুল মতিন।

মামলার রায় ও শাস্তি : হত্যাকান্ডের ৫ শ‘ ৭১ দিন পর বিচার কাজ শেষে মামলার রায় হয়। ২৯ আগস্ট বগুড়ার বিশেষ সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল এম এ সালাম। তার সঙ্গে ছিলেন অপর দুই জন সদস্য। তারা হলেন, মেজর মীর নজরুল ইসলাম ও প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবদুল গণি। ৪০ পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে লেখা সাত হাজার ২১ শব্দের রায় পড়ে শোনাতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগে।

রায়ে প্রধান আসামী আহমদ হোসেন বাবুসহ তিনজনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। অপর দুইজন হলেন শহীদুল ইসলাম নীলু ও আহসানুল হক। এদের মধ্যে বাবু ও আহসান এখনও পলাতক রয়েছেন। তাদের কোন খোঁজ এখনও মেলে নি। এছাড়া অপর আসামী রুহুল আমিন ফেতুকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। মামলার অন্য আসামীরা দোষী সাব্যস্ত না হওয়ায় তাদেরকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।

নীহার বানুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

১৯৫৩ সালের ৯ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের বাসুদেব পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে এসএসসি ও ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাশ করেন। পিতা নজিবর রহমান ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল রাজশাহীর চারঘাটে হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে পরদিন শাহাদত বরণ করেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হন। তার প্রধান শখ ছিলো গান শোনা ও ছবি তোলা। ছবি আঁকার হাতও ছিল বেশ। পরিবারের সদস্য বলতে ছিল মা, পাঁচ বোন ও এক ভাই।

ঘাতক বাবুর সঙ্গে যেভাবে পরিচয় :

প্রথম বর্ষ থেকে একই বিভাগে পড়াশোনা করলেও আহমদ হোসেন বাবুর সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না নীহারের। ১৯৭৫ সালে ৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স পরীক্ষা শুরু হলে প্রস্তুতি ভাল না থাকায় নীহার ড্রপ দেয়ার কথা ভাবছিল। তবুও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়। তবে পরীক্ষা তার ভাল হচ্ছিল না। কিন্তু এরই মধ্যে গুজব রটে বাবুর কাছে পরীক্ষার শর্ট সাজেশন এমনকি স্যারদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্রও পেয়েছে। এর জেরে ১৪ জানুয়ারি প্রথম কোর্সের সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা শেষে নীহার তার বান্ধবীদের সঙ্গে বাবুর কাছে যায় সাজেশন ও নোট নিতে। সেই থেকে বাবুর সঙ্গে নীহারের পরিচয়।

পরে একাধিক বার বাবু নীহারদের বাসায় নোট ও সাজেশন দিতে যাতায়াত করেছে। একপর্যায়ে তারা নিজেদের মধ্যে ধর্ম ভাইবোন সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই আড্ডার ছলে বাবু নীহারকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এতে রেগে নীহার বলে, যে বোনকে বিয়ে করতে পারে সে তো মাকেও বিয়ে করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সময় নীহারের ছবি বন্ধুদেরকে দেখিয়ে নিজের ডার্লিং পরিচয় দেয়ার কথা জানতে পেরে নীহার তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এতে বাবু নীহারের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে। ভুল স্বীকার করে কোরআন শফথ করে বলে, আমাদের সম্পর্ক ভাইবোন ছাড়া অন্য কোন দিকে গড়াবে না বলে শফথ করে। এতে নীহার আশ্বস্থ হয়।

কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় নি ওই বছরেই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়ে থাকা নীহারের। নওগার এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা করে নীহারের পরিবার। এতে নীহারও সম্মতি দেয়। কিন্তু একপাক্ষিক ভালবাসার জেরে নীহারের সারাজীবনের শখ বধু সাজা আর হয়ে ওঠেনি। হতে হয়েছে কঙ্কাল! সদ্য স্বাধীনতাত্তোর একটি দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের এক ছাত্র তার সহপাঠীর অমতে জোর করে বিয়ে করতে চাওয়া। তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা।

সবকিছু মিলিয়ে দেশজুড়ে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আতকে উঠেছিল জনমানুষ। ভীষণভাবে নাড়া খেয়েছিল তৎকালীন সমাজ। প্রতিবাদী হতে নতুন করে এদেশের মানুষকে সাহস যোগায়। সর্বোপরি এ যেন মূঢ় এক মূরের প্রেমার্তা উন্মাদনার শিকার দেসদেমিনা নয়; নীহার বানু, সে এক নিস্করুণ প্রেমহীনতার প্রতিবাদ, মোহত্বহীন যৌবনের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত ধিক্কার।

তথ্য সূত্র: সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যায় রাজশাহীর সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিনের প্রবন্ধ।


শর্টলিংকঃ