Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

ঘরবাড়ি আছে, তবু নৌকায় সংসার


ব্রহ্মপুত্রের বুকে এখন কোনও চর নেই। বিশাল জলরাশির মাঝে মাঝে কিছু ঘরবাড়ির মাথা উঁকি দিচ্ছে। ঘর আছে, বাড়ি আছে কিন্তু একখণ্ড শুকনো মাটি নেই। নৌকা নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চর এলাকায় পৌঁছে দেখা গেল এক অপরিচিত দৃশ্য। গ্রামটির ঘরবাড়িগুলো বুকসমান উচ্চতার পানি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু চোখ সরালেই দেখা মেলে সারি সারি নৌকায় সংসার পেতেছেন এই চরের বাসিন্দারা। চলমান বন্যায় এই পরিবারগুলো কোনও আশ্রয়ের জায়গা খুঁজে না পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নৌকাতেই সংসার পেতেছেন।

শনিবার (২০ জুলাই) দুপুরে মশালের চর গ্রামে কথা হয় এমনই কিছু নৌ-সংসারীদের সঙ্গে। কোনও নৌকায় একটি পরিবার, আবার কোনও নৌকায় একাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান আর প্রতিবেশীর সঙ্গে সঙ্গে গৃহপালিত কিছু প্রাণীও আশ্রয় নিয়েছে একই নৌকায়। বিচিত্র সংসার!

কথা হয় নৌকায় সংসারপাতা ষাটোর্ধ আজাহার আলীর সঙ্গে। আজাহার আলী জানান, ছেলে-পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনিসহ স্ত্রীকে নিয়ে একই নৌকায় এক সপ্তাহ ধরে বাস করছেন। নৌকায় রান্না, নৌকায় খাওয়া চলে। সমস্যা শুধু খাবার পানি আর বউ-বাচ্চাদের শৌচকাজ সম্পন্ন করা। ‘কী যে কষ্টে আছি। ভাতের কষ্ট নাই, পানি আর পায়খানা প্রসাব সারার কষ্ট। আপনাগো বুঝাইতে পারবো না। আমগো ঘরে চাল আছে কিন্তু তরি-তরকারি কই পামু। সবতো পানির তলে। ঘরের ভিতর এক কোমর পানি, নায়ে (নৌকায়) থাকি নায়ে ঘুমাই। ভাইসা ভাইসা সংসার চালাইতাছি।’ বলেন আজাহার আলী।

একই নৌকায় শিশুদের সঙ্গে ছাগল-মুরগিরও আশ্রয় নৌকার ছই গুলিয়ে হতাশা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে ঘোলাচোখে চেয়ে আছেন ব্রহ্মপুত্রের বুকে নৌকায় ভেসে থাকা জমিলা। একই নৌকায় পরিবারের লোকজনসহ বাড়ির অবুঝ প্রাণী ছাগলও আশ্রয় পেয়েছে তাদের সঙ্গে। কথা হয় জমিলার সঙ্গে। জমিলা জানান, নিজেদের ঘরে পানি ওঠায় বাড়িতে থাকতে পারছিলেন না। শেষে ছেলের শুশ্বরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের পানি সেখানেও ঘরছাড়া করেছে তাদের।

জমিলা বলেন, ‘বাবাগো, বিয়াইনের (ছেলের শাশুড়ি) বাড়িত গিয়া উঠছি, কিন্তু সেহানেও পানি উঠছে। শ্যাষে বিয়ানরে নিয়া সবাই অহন নৌকায় ভাসতাছি। ঘরের ভেতরত অহনও বুকসমান পানি, নাতি-নাতনিগো নিয়া কেমতে থাকি। হক্কলরে লইয়া আইজ সাত-আট দিন ধইরা নৌকায় সংসার পাতছি।’ ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে বানভাসি এই নারী বলেন, ‘একদিন চিড়া আর একদিন চাউল পাইছি। আর কিছু পাই নাই। এতগুলা মানুষ কেমনে বাঁইচা আছি ওই উপরওয়ালা জানেন। প্রাণভইরা একটু পানিও খাইতে পারি না।’

ছেলে আমিনুলসহ ঘরের পাশে নৌকা বেঁধে দিনযাপন করেন আমিনা বেগম। ঘরের ভেতর থাকার উপায় নেই বলে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন নৌকায়। সেখানেই খাওয়া, সেখানেই ঘুম। কী দিন, কী রাত!

ছেলেকে নিয়ে আমিনা বেগমের ঘরের পাশে নৌকা বেঁধে দিনযাপনএকই গল্প সব নৌকায়। এরা ভাসছে, পানি কমলে আবারও এরা বাড়িতে ফিরবে। নতুন করে শুরু করবে জীবনযুদ্ধ। নৌকায় আশ্রিত এই পরিবারগুলো প্রতিবছর এভাবেই বন্যায় ভাসে। এমনটাই জানান ওই ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আবু বকর সিদ্দিক। এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘এই চরে প্রায় ৩শ’ পরিবারের বাস। এরা প্রতিবছর বন্যায় ঘরছাড়া হয়। কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ওঠে। কেউবা কোথাও যেতে না পেরে এভাবে নৌকায় ভাসে।’ খাদ্যের চেয়ে এই বানভাসিদের বিশুদ্ধ পানি আর শৌচাগারের প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের বাসিন্দারা প্রতিবছর এভাবেই প্লাবিত হয়। চরাঞ্চলের এই পরিবারগুলোর জন্য খাদ্যের চেয়ে বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের বেশি প্রয়োজন। সরকার থেকে যদি অন্তত পাঁচ-সাত ফুট উঁচু স্থানে টিউবয়েল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে বানভাসিদের দুর্ভোগের স্থায়ী সমাধান হবে।’

৩শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়ার কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রতি বাড়িতেই ধান রয়েছে। কিন্তু ধান ভেঙে চাল করার পরিবেশ নেই। আমি কর্তৃপক্ষকে বলেছি আরও বেশি বেশি শুকনো খাবারের বরাদ্দ প্রয়োজন।’

বানভাসিদের সমস্যার কথা জেনে ত্রাণ তৎপরতা বাড়ানোর আশ্বাস দেন উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মশালের চরসহ ওই এলাকার বানভাসিদের জন্য স্থায়ীভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য শিগগিরই টিউবয়েল স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া শৌচাগারের সমস্যাও সমাধান করা হবে।’ কৃতজ্ঞতা: বাংলা ট্রিবিউন


Exit mobile version