- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

বঙ্গবন্ধুর মাওলানা


সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ:

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বাঙালির চেতনার মহানায়ক মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ একটি নাম। একটি ইতিহাস। একটি দেশ, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্বের মহানায়ক। আজন্ম সংগ্রামী এক সিপাহসালার। বাংলা ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা। তিনি হলেন ইতিহাসের সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম সিংহের মতো গর্জে উঠেছিলেন এবং পার্লামেন্ট থেকে ৩৫ জন সদস্য নিয়ে তার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন এবং তিনি গ্রেফতার হন।

একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আইন পরিষদে এটিই প্রথম প্রতিবাদ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ৩টায় পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে অধিবেশন সেদিনের জন্য স্থগিত রাখার দাবি জানান আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছে একটা নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা, যারা আমাদের ভাবী আশা-ভরসাস্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে ইনকোয়ারি তারপর হাউস চলবে।’ একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে এটাই ছিল আইন পরিষদে প্রথম বক্তব্য।

শুধু কি তাই! এই মাওলানা সেই মাওলানা। তিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে পার্লামেন্টে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে বাংলার সম্মান উঁচু করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা। ১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট সব ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলায় বক্তৃতা শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি গণপরিষদ সদস্যরা নানা উপহাস করে এ সময় তর্কবাগীশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু উপহাস উপেক্ষা করেই তর্কবাগীশ বাংলায় বক্তব্য দেন। বাংলায় বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য ওই সময় আইনসভায় কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাওলানা তর্কবাগীশ বেশ কয়েকবার স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণের পর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য লোক নিয়োগ করা হয়। এর আগে পাকিস্তান গণপরিষদের কোনো সদস্য বাংলায় বক্তৃতা করেননি।

তিনি আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলা বক্তৃতা চালু ও বাংলা ভাষা রেকর্ড করার প্রথা চালু করে এক ঐতিহাসিক অবদান সৃষ্টি করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন হয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন এক নেতা। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯১৯ সালে খিলাফত আন্দোলন, ১৯২২ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নসিঁড়িখ্যাত ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা বিদ্রোহ’এর নেতৃত্ব দেন। এর পর থেকে আজীবন বাংলা ও বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপসহীন এক বীর সিপাহসালার। বিদ্রোহী এক যুদ্ধা। মুক্তিকামী মানুষের চেতনার মহানায়ক। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি। তার হাত ধরেই তৈরি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা। ’৭০-এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ব্যাপক জনমত তৈরির লক্ষ্যে মাঠে-ময়দানে জনগণকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি সর্বশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের জনমত তৈরির লক্ষ্যে গঠন করেন ওলামা পার্টি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তার নাম দিয়েছিল ‘কাফের মাওলানা’। তারা তার বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

দুজন মাওলানা আমাদের জাতি গঠনের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তাদের রয়েছে বলিষ্ঠ অবদান। এর একজন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অন্যজন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ।

মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন একজন আজীবন সংগ্রামী মানুষ। তিনি একাধারে জাতীয় নেতা, ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় রাজনীতিবিদ, সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক, বর্গা আন্দোলনের কাণ্ডারি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীর যোদ্ধা। তিনিই প্রথম পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তৃতাকারী বীর। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকারীদের সমর্থনে পার্লামেন্ট থেকে ওয়াকআউট করে রাস্তার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ভাষা আন্দোলনের কারণে দীর্ঘদিন কারাবরণও করেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। যে ভাষণের সীমাহীন ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই।

১৯৫৬-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা দশ বছর মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু তখন যুগ্ম সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তর্কবাগীশের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর মানস গঠনে তর্কবাগীশের প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের একটা অংশ কেটেছে এ মাওলানার সান্নিধ্যে। বঙ্গবন্ধু মাওলানাকে কাছ থেকে দেখেছিলেন। দুজনের জীবনের নানা স্মৃতিকথা কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে ইতিহাসের পরতে পরতে।

‘বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। উনি আমাকে আগে থেকেই চেনেন। আমাদের দিনাজপুরের বাসায় দেখা হয়েছে। মাওলানা তর্কবাগীশ আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বললাম। আব্বা আমাকে বললেন, উনি তোমার মাওলানা তর্কবাগীশ চাচা।’ এরপর সেই ৩৬ মাইলের বর্ণনা দেন মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, ‘ঠাকুরগাঁ থেকে ৩৬ মাইল পথ ভেঙে গাড়ি ছুটছে। বঙ্গবন্ধু গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীতের সুর ভাঁজছেন। মাইল কয়েক পরপরই জনতার ঢেউ। বঙ্গবন্ধুকে ভাষণ দিতেই হবে। গাড়ি থামছে এবং বঙ্গবন্ধু সাদা হ্যান্ড মাইক হাতে মিনিট তিন চারেক করে ভাষণ দিচ্ছেন। আবার ছুট।’

‘চলন্ত গাড়িতে বঙ্গবন্ধু, আব্বা, মাওলানা তর্কবাগীশ মাঝে মাঝেই নির্বাচন বিষয়ে কিছু কিছু কথা বিনিময় করছেন। এমন সময় হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে মাওলানা তর্কবাগীশ আমাকে প্রশ্ন করলেন, বড় হয়ে কী হতে চাও? এক মুহূর্তে আমার হয়ে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, ও তর্কবাগীশ হবে।’ তর্কবাগীশ বললেন, মুজিব তুমি সবাইকে তর্কবাগীশ বানিয়ে দিবে নাকি। আব্বাকে বললেন, সে নিজেও তর্কবাগীশ হতে চায়। মাওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুর টোকাটুকু উপভোগ করেছেন। ‘বিস্ময়কর হলো, পরবর্তী সময়ে আমি জাতীয় পর্যায়ে বিতার্কিক হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। উনারা কেউ নেই আজ। আমার বুকের ভেতর আছে কেবল প্রতিধ্বনি।’ (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩৬ মাইল মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, ১৫ আগস্ট ২০১৫। চ্যানেল আই)

বঙ্গবন্ধু ও আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ

মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশেরর নাতি সৈয়দ হাদি তর্কবাগীশ একুশের সংকলনে ‘অগ্নিগর্ভে একুশ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের যেদিন প্রথম তর্কবাগীশের সঙ্গে দেখা হয় সেদিন বলেছিলেন, নেতা আমি আপনার মতো বক্তা হতে চাই।’

হ্যাঁ একদিন তিনি এমন এক বক্তৃতা দিলেন, তর্কবাগীশের বক্তৃতা হার মানাল। তিনি বঙ্গবন্ধুতে পররিণত হলেন। তার সেই বক্তৃতা তাকে তর্কবাগীশ হওয়ার স্বপ্ন কেবল নয়, তার চেয়ে অনেক উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছিল। ৭ মার্চের বক্তৃতায় তিনি গুরুর মতো এক কিংবদন্তির ভাষণে উদ্বেলিত করলেন পুরো জাতিকে। সেই ৭ মার্চের অমর ভাষণ পৃথিবীর সেরা বক্তৃতার একটা। এটি শুধু কোনো বক্তৃতা নয়। এক অমর কবিতা। এক অমর ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব, কৈশোর কেটেছে পারিবারিক ধর্মীয় আবহে। পিতা শেখ লুত্ফুর রহমান ছিলেন সীমাহীন আলেমভক্ত ও ধার্মিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়া যৌবন বয়সে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন দুই আলেমের হাত ধরে। তার সরাসরি রাজনৈতিক দুই গুরুই দেওবন্দ পাস মাওলানা। ফলে আলেমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অন্য রকম এক সুগভীর সম্পর্ক ছিল। ইতিহাস তাই প্রমাণ করে।

কবির ভাষায়, একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কী দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে, জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি’? শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

 

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ: লেখক ও গবেষক