তিব্বত যে জিনিসগুলো গোপন করেছে সারাবিশ্বের কাছে


বিপাশা আনজুম ঊষা:
সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে ‘নিষিদ্ধ দেশ’ তিব্বত, আর ‘নিষিদ্ধ নগরী’ তিব্বতের রাজধানী লাসার কথা পড়েনি এমন শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুবই কম। কী আছে তিব্বতে? এ ব্যাপারে সবার মনে রয়েছে প্রশ্ন। কোনটি নিষিদ্ধ দেশ—প্রশ্ন করলে এক বাক্যে সবাই বলবে ‘তিব্বত’। কিন্তু এ নিষেধের পেছনের রহস্য অনেকেরই অজানা। কেন তিব্বতকে নিষিদ্ধ দেশ বলা হয়? কী এমন গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় আবৃত তিব্বতের অবয়ব?

Tibbat Visit
হিমালয়ের উত্তর অংশে শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে তিব্বত নামের রহস্যময় রাজ্যটি। তিব্বত হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি দেশ। ১৯১২ সালে ত্রয়োদশ দালাই লামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি স্ব-শাসিত অঞ্চল তিব্বত। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। এ অঞ্চলটিকে চীনের অংশ বলা হলেও এখানকার বেশির ভাগ তিব্বতি এ অঞ্চলকে চীনের অংশ মানতে নারাজ। এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিরা স্বাধিকার আন্দোলন করলে, তা ব্যর্থ হয়। তখন দালাই লামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় নিয়ে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিব্বতের রহস্যের পেছনে এর প্রকৃতি ও দুর্গম পরিবেশ অনেকাংশে দায়ী। রাজধানী লাসা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোবি মরুভূমি। মরুভূমির নিষ্ঠুর ও কষ্টদায়ক পরিবেশ এসব এলাকার মানুষকে কাছে আনতে নিরুৎসাহিত করে। তিব্বতের বেশির ভাগ ভূ-ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুটেরও ওপরে অবস্থিত হওয়ায়, সেখানে বসবাস করা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি কষ্টকর।

tibbat china
তিব্বতের স্থলভাগ বছরের প্রায় আট মাস তুষারে ঢেকে থাকে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বতকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে অনেক রহস্য। তিব্বতের রাজধানী লাসা বিশ্বব্যাপী ‘নিষিদ্ধ নগরী’ হিসেবে পরিচিত ছিল অনেক আগে থেকেই। তিব্বত বা লাসায় বাইরের বিশ্ব থেকে কারও প্রবেশ করার আইন না-থাকায় এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে সবার কাছে একটি রহস্যময় জগৎ হিসেবে পরিচিত ছিল।

কী আছে লাসায়—তা দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকত সমগ্র বিশ্ব। লাসার জনগোষ্ঠী, শহর, বন্দর, অট্টালিকা সবকিছুই ছিল সবার কাছে একটি রহস্যঘেরা বিষয়। লাসা নগরীতে ছিল বিখ্যাত ‘পোতালা’ নামক একটি প্রাসাদ। এই প্রাসাদ প্রথমবারের মতো বহির্বিশ্বের মানুষেরা দেখতে পায় ১৯০৪ সালে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকায় এই বিখ্যাত অট্টালিকার ছবি ছাপা হয় সে সময়।

তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড় ও গুহা। সেই পাহাড়ি গুহাগুলোতে বাস করেন বৌদ্ধ পুরোহিত লামারা। তিব্বতিরা অত্যন্ত ধর্মভীরু হওয়ায় ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাই লামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বতে লামা নামে পরিচিত। ‘লামা’ শব্দের অর্থ ‘সর্বপ্রধান’, আর ‘দালাই’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞানসমুদ্র’। অর্থাৎ ‘দালাই লামা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘জ্ঞানসমুদ্রের সর্বপ্রধান’।

tibbat visa
ধর্মগুরু বা দালাই লামা বাস করেন সোনার চূড়া দেওয়া পোতালা প্রাসাদে। ১৩৯১ সালে প্রথম দালাই লামার আবির্ভাব ঘটে। দালাই লামাকে তিব্বতিরা বুদ্ধের অবতার বলে মনে করে। তিব্বতিদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাই লামার পদে অভিষিক্ত হন, তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তাঁর মধ্যে আবির্ভূত হয়। দালাই লামা নির্বাচনের পদ্ধতিটাও বেশ রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর। তিব্বতিদের দালাই লামা বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটা বিচিত্র।

তিব্বতি প্রথামতে, কারও মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার মরদেহের সৎকার করা হয় না। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, মৃত্যুর পরও আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডল ত্যাগ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মরদেহটি তাদের বাড়িতে রেখে দেয়। কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে এক সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসেন।

ধ্যানযোগে লামারা দেখতে পান সেই সরোবরে স্বচ্ছ পানির ওপর ভেসে উঠছে একটি গুহার প্রতিবিম্ব, যার পাশে রয়েছে একটি ছোট বাড়ি। প্রধান লামা তাঁর সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এঁকে দেবেন নতুন দালাই লামার ছবি। তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যান শিশু অবতারের খোঁজে। তাঁরা তিব্বতের ঘরে ঘরে গিয়ে সেই ছবির হুবহু শিশুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। আর এভাবেই খুঁজে বের করা হয় নতুন দালাই লামাকে।

Dalai Lama
তিব্বতের লামা ও সাধারণ মানুষেরা প্রেতাত্মাকে খুবই ভয় পায়। অধিকাংশ তিব্বতির ধারণা, মানুষের মৃত্যুর পর দেহের ভেতর থেকে প্রেতাত্মারা মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওই প্রেতাত্মা লাশ সৎকার হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের ক্ষতি করার জন্য ঘুরে বেড়ায়। তারা কখনো মানুষের ওপর ভর করে, কখনো পশু-পাখি কিংবা কোনো গাছ অথবা পাথরের ওপরও ভর করে। প্রেতাত্মাদের হাত থেকে বাঁচতে ও প্রেতাত্মাদের খুশি রাখতে তিব্বতিরা পূজা করে থাকে।

তিব্বতে সরকারি ভাষা হিসেবে চীনা ভাষার প্রচলন থাকলেও তিব্বতিদের ভাষার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। তাই চীনের বেশ কিছু প্রদেশ এবং ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে তিব্বতি ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। তিব্বতিদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আচার হলো-মৃতদেহ সৎকার। তাদের মৃতদেহ কাউকে ছুঁতে দেওয়া হয় না। ঘরের কোনায় মৃতদেহটি বসিয়ে চাদর অথবা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মৃতদেহের ঠিক পাশেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পাঁচটি প্রদীপ। তারপর পুরোহিত পোবো লামাকে ডাকা হয়। পোবো লামা একাই ঘরে ঢোকেন এবং ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেন।

Saga-Dawa-Festival-Tibet

এরপর পোবো মন্ত্র পড়ে শরীর থেকে আত্মাকে বের করার চেষ্টা করেন। প্রথমে মৃতদেহের মাথা থেকে তিন-চার গোছা চুল টেনে ওপরে তোলা হয়। তারপর পাথরের ছুরি দিয়ে মৃতদেহের কপালের খানিকটা কেটে প্রেতাত্মা বের করার রাস্তা করে দেওয়া হয়। মৃতদেহকে নিয়ে রাখা হয় একটি বড় পাথরের টুকরোর ওপর। একটি মন্ত্র পড়তে পড়তে মৃতদেহের শরীরে বেশ কয়েকটি দাগ কাটা হয়। দাগ কাটার পর একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে সেই দাগ ধরে ধরে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। তারপর পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানো হয়।

Tibet_mountains_monks
তিব্বতের সামাজিক অবস্থার কথা বলতে গেলে বলতে হয় এমন এক সমাজের কথা, যা গড়ে উঠেছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। তখন পীত নদীর উপত্যকায় চীনারা ‘জোয়ার’ (এক ধরনের শস্য) ফলাতে শুরু করে। অন্যদিকে আরেক দল রয়ে যায় যাযাবর। তাদের মধ্যে থেকেই তিব্বতি ও কর্মী সমাজের সূচনা হয়। তাদের খাবার-দাবারেও রয়েছে ভিন্নতা। শুনলে অবাক হতে হয় যে, ‘উকুন’ তিব্বতিদের অতি প্রিয় খাবার।

ঐতিহ্যগতভাবে তিব্বতি সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ যাযাবর বা রাখাল জীবনযাপন। ভেড়া, ছাগল ও ঘোড়া পালন তাদের প্রধান জীবিকা। শুধু তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ এই যাযাবর রাখাল সম্প্রদায়। এরা কখনো চাষাবাদের কাজ করে না। মোট ভূমির ৬৯ শতাংশ এলাকা চারণ বা তৃণভূমি। চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে তিব্বতিরাও ভীষণ চা-প্রিয়। তাদের বিশেষ চায়ে মেশানো হয় মাখন ও লবণ। তবে তিব্বতিদের প্রধান খাবার হলো ‘চমবা’। গম ও যবকে ভেজে পিষে ‘চমবা’ তৈরি করা হয়। আধুনিক বিশ্ব দিন দিন আরও আধুনিক হলেও আজও তিব্বত বিশ্বে রহস্যময় এক জায়গা হিসেবেই খ্যাত।


শর্টলিংকঃ