Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

মধ্যবিত্ত ঘরের শিশুরাই বেশি করোনাঝুঁকিতে


জিয়াউল গনি সেলিম :

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজনীন পারভীন স্বাতী বলছেন, ‘যেসব শিশু হরলিক্স, কমপ্ল্যান, বুস্ট, মালটোভা, বর্নভিটা ইত্যাদি খায়, তারাই বেশি করোনাঝুঁকিতে। স্বচ্ছল পরিবারগুলো বেশির ভাগ শিশুর পুষ্টির জন্য ভরসা করে এ ধরনের পরিপূরক খাবারের ওপরই। কিন্তু  বেশি বেশি শাক-সবজি বা প্রাকৃতিক খাবারেই অভ্যস্ত নিম্নবিত্ত ঘরের শিশুরা।এ কারণে তুলনামূলকভাবে তাদের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।’ 


রাজশাহী নগরীর ষষ্টীতলা এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন নাটোরের একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক আল আমিন। একমাত্র ছেলে সা’দ আল রিয়াজ প্রত্যয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। করোনায় ছেলের স্কুল, প্রাইভেট; এমন কী বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরিও বন্ধ।

তবে লকডাউন শিথিলতার সুযোগে একঘেয়েমী কাটাতে প্রায় তিন মাস পর এই প্রথম ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছেন বাইরের চেনাজানা সেই পরিবেশ দেখাতে। মাস্ক বাবা ও ছেলের মুখে মাস্ক দিয়ে বেরিয়েছেন।নগরীর অলোকার মোড়ে একটি চায়ের স্টলে বসে আল আমিন বলছিলেন, ‘এখন ২৪ঘণ্টাই বাসার ভেতরে। আগে প্রথম প্রথম বাসায় ভেতরে থাকায় অস্থির হয়ে উঠতো। মেজাজ খিটমিটে করতো। রাগারাগি করতো। বাইরে বের হওয়ার জন্য জেদ করতো। তবে করোনার আতঙ্কে বাসা থেকে থেকে অভ্যাস হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে এক একাই খেলা করে। বিটিভিতে অনলাইনে ক্লাসে অনুষ্ঠান দেখে। এভাবেই চলছে’।

করোনায় হারিয়েছে শিশুদের দুরন্তপনা। নেই কোনো কোলাহল বা হৈচৈ। পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্রগুলোও বন্ধ। রেস্টুরেন্টেও ঝুলছে তারা। ফলে খেলাধুলাও আটকে গেছে চার দেয়ালের মাঝে। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর কসরত করে অনেকেই। নগরীর সুলতানাবাদ এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হোসেনের মেয়ে সামিহা হোসেন রাজশাহী সরকারি পিএন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বাসাটাই যেন এখন তার পুরো জগৎ।করোনাআতঙ্কে মেয়েকে নিয়ে বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না মা-বাবা।

আরাফাত  বলেন,‘ আগে পড়াশোনার তাড়া ছিল। বয়সে ছোট হলেও  রুটিন করে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া, স্কুলে যাওয়া-এসব করতে হতো। কিন্তু করোনায় সবকিছুই থমকে গেছে। কোথাও ঘুরতে বের হওয়ারও উপায় নেই। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ। তাই মেয়ের এখন স্মার্ট ফোনের প্রতি আসক্তি বেড়েছে। সময় কাটাতে সারাদিন ধরে মোবাইল ফোনেই গেম খেলে। কার্টুন দেখে। রাতে  ঘুম না আসা পর্যন্ত  হাতে ফোন থাকে ওর। এমন কি মোবাইল ফোন হাতে না দিলে খাওয়ানোই কঠিন। বইখাতা ছেড়ে এখন মোবাইলই নেশা তার’।

শুধু যে স্কুলগামী শিশুরাই  মোবাইলে আসক্ত হচ্ছে, তা নয়। দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের মাঝেও এ আসক্তি মারাত্মক। তাদের চোখ আটকে আছে স্মার্ট ফোনের পর্দায়।সারাটা দিন আসক্তি নিয়ে দেখছে ভিডিও গেম কিংবা কার্টুন। কখনো বা জড়াচ্ছে দুষ্টমীতে। খিটমিটে হচ্ছে মেজাজও।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য বলছে  প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম এবং ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রায় ছয় শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে, যার বড় একটা অংশই যুক্ত থাকে নানা ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের সঙ্গে।

পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণা মতে, যেসব শিশু কম্পিউটার, টেলিভিশন ও ভিডিও গেম নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হীনমন্যতার শিকার হয় বেশি। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের অটিজম, মনোযোগ হ্রাস, হতাশা ও তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে ভিডিও গেম আসক্তির সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়। কানাডার অ্যাসোসিয়েশন অব মেন্টাল হেলথের জরিপে উঠে এসেছে, ৭ থেকে ১২তম গ্রেডের যেসব শিক্ষার্থী দিনে দু’ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়, তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।

টেলিযোগাযোগ কোম্পানি টেলিনর বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছে, পরিবারের শিশুরা অনলাইনে গেম খেলতে গিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় গালাগালি, বর্ণবাদী ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, যা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রচণ্ড বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

দেশের প্রখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসাবিদ অধ্যাপক ডা. মামুন হুসাইন ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ঘরে থাকায় শিশুদের মানসিক বিকাশ মারাত্মভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।যার প্রভাব পড়তে পারে বড় হলেও। বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের প্রতি আসক্তি না কমালে বাইরের চেনাজানা জগত সম্পর্কে শিশুদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ধারণা তৈরিতে সমস্যা হবে। এজন্য এই পরিস্থিতিতে শিশু বেশি বেশি সময় দিতে হবে অভিভাবকদের। তাদের নিয়ে খেলতে হবে। উদ্ভাবনী জ্ঞান তৈরি হয় এমন মজার মজার খেলা দিতে হবে। শিশুদের মনোজগত তৈরিতে গল্প করতে হবে। শিশুদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে হবে। অনেকে মা-ই সংসারের কাজকর্মের জন্য শিশুদের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়ে নিশ্চিত হতে চান। এটাও পরিহার করতে হবে।

এদিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, দেশে মোট করোনা সংক্রমণের ১০শতাংশই শিশু। এরমধ্যে নবজাতক থেকে ১০বছর বয়সী সংক্রমিত হয়েছে এক হাজার দুশোর বেশি শিশু। তবে ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী আক্রান্তই বেশি, যা তিন হাজার। আর মারা গেছে অন্তত ১১জন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজনীন পারভীন স্বাতী বলছেন, করোনায় বাড়তি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিশু, যারা ঘরেই থাকে বেশি সময় বা বাইরের রোদ বৃষ্টিতে বের হয় না অর্থাৎ প্রকৃতির সাথে যাদের নিবিড় যোগাযোগ নেই তাদের শরীরে হুটকরে অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধতে পারে। এ ছাড়া অনেকেই শিশুদের পরিপূরক খাবার বিশেষ করে হরলিক্স, কমপ্ল্যান, বুস্ট, মালটোভা, বর্নভিটা ইত্যাদি খাবারের ওপরই বেশি ভরসা করেন। এটি মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে শিশুস্বাস্থ্যে। এসব খাদ্য কখনোই হার্ড ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে না। এ কারণে এ ধরনের শিশুদেরই করোনার ঝুঁকি বেশি’।

আইসিডিডিআরের মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের জ্যেষ্ঠ মনোবিদ ডা. শামীমা সিরাজী বলেন, করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে আমরা যদি শুধু নেতিবাচক চিন্তা করি, তাহলে চরম হতাশায় ডুবে যাব। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। দেখা দিবে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। পরিবারের বড়রা ভেঙে পড়লে শিশুদের কী হবে? বরং শিশুদের নিয়ে এই সময়টা কত ভালোভাবে পাড়ি দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই বাবা–মাকে করতে হবে।

তবে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লাহ জানিয়েছেন, সংক্রমিত শিশুদের মধ্যে অনেকেরই কোনো ধরনের উপসর্গ প্রকাশিত হয় নি।তাই শিশুদের বাজারে যাওয়া বা হাওয়া খেতে না বেরুনোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।


Exit mobile version