বিশেষ প্রতিবেদক :
ইটভাটার ধোঁয়ায় কপাল পুড়তে বসেছে রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষীদের। প্রতিবছরই ভাটারসংখ্যা বাড়ায়, বাড়ছে ক্ষতিও। চাষীরা বলছেন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ধীরে ধীরে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে আম। তবে ইটভাটা মালিকদের দাবি, ইটভাটার কারণে কোনো ক্ষতি নেই আম বাগানের। যদিও অবৈধ ভাটা অপসারণে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

রাজশাহী অঞ্চলের আম কেবল দেশের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের নানাদেশেও। তাই রপ্তানিমুখী আমের বাজার ধরতে মুকুল হওয়া থেকেই বেশ সচেতন কৃষকরা। কিন্তু চাষীদের সেই আশায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইটভাটা।
রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইটভাটাই গড়ে উঠেছে ফসলি জমি ও লোকালয়ে। ভাটার আশপাশে রয়েছে ফলদ বাগান, জনবসতি, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সরকারি নিবন্ধন ছাড়া ইটভাটা স্থাপন, ইট তৈরি করা কিংবা ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া নিবন্ধনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও আবশ্যক। এজন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনের পর এডিসির নেতৃত্বে সরেজমিন তদন্ত হয়। তদন্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানও থাকেন। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই জেলা প্রশাসক কর্তৃক নিবন্ধন দেয়া হয়।

কিন্তু রাজশাহী জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির হিসাব মতে, জেলায় ১৫০টির মতো ইটভাটা থাকলেও পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র কয়েকটির। আর নিবন্ধন রয়েছে প্রায় ৫০টি ইটভাটার। দেখা যায়, নগরীর বাইপাস মহাসড়কঘেঁষে আবাদি জমির ওপর গড়ে উঠেছে ১০-১৫টি ইটভাটা। এছাড়া পুঠিয়া, বাগমারা, তানোর, গোদাগাড়ী, দুর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা, পবা, মোহনপুর উপজেলা ও বিভিন্ন পৌরসভা সদরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। কৃষকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে কৃষিজমি লিজ নিয়ে এসব ইটভাটা স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া আইন অনুযায়ী কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ, খড়ি ও বাঁশ।
রাজশাহীর পবা উপজেলার বুধপাড়া এলাকার দুরুল হোদা জানান, তার পাঁচ বিঘা জমিতে আম রয়েছে। কিন্তু পাশেই ইটভাটা থাকার কারণে ধোঁয়া এসে আঘাত হানছে বাগানে। এ কারণে আমের মুকুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আরেক আমচাষী আব্দুস শুকুর বলেন, কয়েক বছর থেকে এই সংকট ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আম মটরদাঁনা হওয়ার সময় থেকেই ঝরে যাচ্ছে। আর একটু বড় হলে নিচ থেকে কালো দাগ হয়ে শুকিয়ে যায়। এ অবস্থার কারণে ক্ষতি হওয়ায় আমের পাইকাররাও আসছেন না। আর স্প্রে করতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে আমগাছের বোরন সিনথেসিস (এক প্রকার খাদ্য) নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে ফলনেও বিপর্যয় ঘটবে। তাই আমের মওসুমে ভাটাগুলো বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

তবে রাজশাহী ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি সভাপতি মো. সদরুল ইসলাম বলছেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, ‘কেবল ধোঁয়াই নয়, নানা কারণেই ক্ষতি হতে পারে আমের মুকুলের। অনেক জায়গাতেই ভাটার পাশেও আমের ফলন ভাল হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গা হচ্ছে না। কাজেই একতরফাভাবে ভাটাকে দায়ী করা যাবে না’।
এ বিষয়ে রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ জানান, এরই মধ্যে তারা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের অবৈধ ইটভাটাগুলোতে নোটিস পাঠিয়েছেন। এগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, এমনকি নিবন্ধনও নেই। শিগগিরই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, মওসুমী ফল আমকে কৃষকদের জন্য লাভজনক করতে সব ধরনের উদ্যোগ নিশ্চিত করা হবে। তাই অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বলেন, রাজশাহীর আম এখন বিদেশেও সমাদৃত। তাই কৃষকরা যাতে নির্বিঘ্নে আম উৎপাদন করতে পারেন ও ন্যায্য দাম পান তা নিশ্চিত করা হবে। এরইমধ্যে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।