নিজের উন্নয়নে মেয়াদ পার দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের


ইউএনভি ডেস্ক নিউজ:

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পরিষদের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই কাজ করা হয় ধাপে ধাপে কোটেশনের মাধ্যমে। কোনো টেন্ডার না ডেকে নামে-বেনামে ঠিকাদার নিয়োগ করে মূলত কাজটি করেন তিনি নিজেই। ফলে এই কাজে লাখ লাখ টাকা তছরুপ হয়েছে।

   দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের পাঁচ বছর আগেও ছিল একটি জরাজীর্ণ বাড়ি। উপজেলা সদরে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটুকু ছিল হাঁটার মতো গলিপথ। কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁর বাড়িটিও যেমন হয়েছে আলিশান, তেমনি প্রকল্পের টাকায় বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটিও হয়েছে কার্পেটিং। উপজেলা পরিষদের পুকুরের রাস্তা দখল করে বাড়ি যাওয়ার এই রাস্তাটি করা হয়েছে প্রকল্পের টাকায়। এর বাইরে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

সূত্র মতে, ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন নজরুল ইসলাম। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য করতে থাকেন তিনি। এ ছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে সরকারি অর্থ লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফলে উপজেলার মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু তাঁর ভাগ্যে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

২০১৪ সালের আগে এই নজরুল ইসলামের অর্থের পরিমাণ বলতে ছিল লিজ নেওয়া দুটি পুকুর আর জীর্ণ একটি পুরনো পাকা বাড়ি। কিন্তু এই সম্পদের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে তাঁর ঋণের পরিমাণও ছিল বেশ। কিন্তু গত পাঁচ বছরে তিনি তিনতলা অট্টালিকা বানিয়েছেন, উপজেলা চত্বরসংলগ্ন নিজস্ব জমিতে এই বাড়ি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে দুই কোটি টাকা। দুর্গাপুর উপজেলার মধ্যে এটাই সবচেয়ে আধুনিক ভবন বলে লোকজন একবাক্যে মানে।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পরিষদের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই কাজ করা হয় ধাপে ধাপে কোটেশনের মাধ্যমে। কোনো টেন্ডার না ডেকে নামে-বেনামে ঠিকাদার নিয়োগ করে মূলত কাজটি করেন তিনি নিজেই। ফলে এই কাজে লাখ লাখ টাকা তছরুপ হয়েছে।

সূত্র জানায়, দুর্গাপুরে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের আওতায় যেসব চাল ও গম বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেসব চাল ও গম বিক্রি করতে হয় নজরুল ইসলামের পছন্দের কালোবাজারির কাছে। ফলে বাজারমূল্যের চেয়ে টনপ্রতি অন্তত এক হাজার টাকা কম দামে প্রকল্পের চাল-গম বিক্রি করতে বাধ্য হন প্রকল্প সভাপতি-সম্পাদকরা। আর এর কমিশনের টাকাও যায় নজরুলের পকেটে। এর বাইরে তিনি উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে টিয়ার, কাবিখাসহ সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দ দিয়ে সেখান থেকে কমিশন আদায় করেছেন দুই হাতে।

উপজেলা পরিষদ চত্বরের পাশের পুকুরের পূর্ব পাশেই তাঁর নিজস্ব বাড়ি। সেই বাড়িতেই বসবাস করেন তিনি। কিন্তু চেয়ারম্যান হিসেবে অন্য বাড়িতে ভাড়া থাকেন দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার করে প্রতি মাসে বহু টাকা পকেটে পোরেন। এর বাইরে দুর্গাপুরের দাউকান্দি কলেজ সরকারীকরণের নামে অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগসাজশ করে দুজনে মিলে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রায় ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগও ওঠে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। পরে আরো ৩০ লাখ টাকা আদায় করা হয় কলেজটি সরকারীকরণের নামে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নজরুল ইসলাম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর দুর্নীতি আর অনিয়মেই ব্যস্ত ছিলেন। তিনি দলের নেতাকর্মীদের চাকির না দিয়ে নিজের সন্তান, শ্যালকদের চাকরি পাইয়ে দিতে ব্যস্ত ছিলেন। দলের নেতাকর্মীদের কোনো মূল্যায়ন করেননি এই পাঁচ বছরে। তাঁর সঙ্গে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ এবং দুর্গাপুর পৌর মেয়র তোফাজ্জল হোসেনের বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে চরমে।

দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের বিলাসবহুল বাড়ি এবং বাড়িতে যাওয়ার জন্য সরকারি জমি দখল করে রাস্তা। ছবি- কালেরকণ্ঠ।

তবে গত সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন চাপের মুখে নজরুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত মজিদ ও তোফাজ্জলের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান দলের নতুন মুখ ডাক্তার মনসুর রহমান। কিন্তু মনোনয়ন পাওয়ার আগে নজরুল গুটিকয়েক নেতাকর্মী নিয়ে সাবেক এমপি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার পক্ষে মাঠে ছিলেন। আর আব্দুল মজিদ, তোফাজ্জলসহ দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী ছিলেন এমপির বিপক্ষে।

দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুর্গাপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল মূলত এই নজরুলকে কেন্দ্র করেই। তিনি সরকারি সব প্রকল্প নিজেই বগলদাবা করতেন। এ কারণে তাঁর সঙ্গে অন্য দুই ভাইস চেয়ারম্যানের কখনো সম্পর্ক ভালো ছিল না। আর দলীয় নেতাকর্মীরা তাঁর কাছে অবমূল্যায়নের শিকার হন। তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করে যাচ্ছেন।

উপজেলা সদরের বাসিন্দা আনসার আলী বলেন, ‘উপজেলার অনেক রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে; কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ি আর ওই বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটি হয়েছে আধুনিক। গত পাঁচ বছরে এ দুটি কাজই তিনি করেছেন। আর প্রকল্পের কমিশন আদায় করেছেন সমানে।’

দুর্গাপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতি বলেন, ‘নজরুল ইসলাম উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে আওয়ামী লীগের আরো ক্ষতি করেছেন। কারণ তিনি দুই হাতে অর্থ কামাই করতে গিয়ে দলের নেতাকর্মীদের কোনো মূল্যায়ন করেননি। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও তাঁর সঙ্গে কোনো নেতাকর্মী এখন নেই। দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী অন্য নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করে।’

এ প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। আমার নিজস্ব সম্পদ দিয়েই বাড়ি তৈরি করেছি। বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটি প্রকল্পের অর্থেই তৈরি করা হয়েছে। কারণ রাস্তাটি সরকারি। পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদেরও মূল্যায়ন করা হয়েছে। যারা এসব ছড়াচ্ছে তারা দলের লোক নয়।’

সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ


শর্টলিংকঃ