আড়াইহাজারে মানব পাচারের ভয়ংকর জাল


ইউএনভি ডেস্ক:

খাবার আর পানি অভাবে বাঁচার তাগিদে লতাপাতা কিংবা পোকামাকড়ই ভরসা। কারও শরীরে এমন পচন ধরেছে যে সেখানে পোকা বাসা বেঁধেছে। কারও নীলাভ হয়ে যাওয়া লাশ পড়ে থাকে বিষাক্ত সাপ না হয় বিচ্ছুর কামড়ে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে কত বাঙালি যুবক এভাবে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছেন আর নিজেদের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন তার সঠিক সংখ্যা নেই।

শুধু থাইল্যান্ড মিয়ানমারই নয় টেকনাফ উখিয়ার কোনো গহিন জঙ্গলেও জিম্মিদশায় ঠিক কত যুবক আটকে আছেন সিন্ডিকেটের খপ্পরে তারও কোনো হিসাব নেই। মুক্তিপণ দিয়ে বৃহস্পতিবার ফিরে আসা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের যুবক নাজমুলের অভিজ্ঞতার বর্ণনা ছিল ঠিক এমনই। নাজমুলের মতো আড়াইহাজারের বিশনন্দি এলাকার বাদশা মিয়া, সুমন মিয়া নামের আরও ২ যুবককে মুক্তিপণ দিয়ে নিয়ে এসেছে তাদের পরিবার।

আড়াইহাজারে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র ও তাদের স্থানীয় এজেন্টরা। নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে দালাল চক্রের মিষ্টি কথায় এক ভয়ংকর পাতা ফাঁদের শিকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এ যুবকরা। সরেজমিন গত দুদিন আড়াইহাজারের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে মিলেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, আড়াইহাজারের কড়ইতলা, রামচন্দ্রদী, মানিকপুর, চৈতনকান্দা, দয়াকান্দা, টেটিয়া ও শম্ভুপুরা-এ সাত গ্রামেরই দালাল চক্রের খপ্পরে আটকে আছেন প্রায় ৩০ যুবক। তাদের মধ্যে টেকনাফ এলাকায় জিম্মি আছেন আড়াইহাজারের কড়ইতলার বিল্লাল, জুয়েল, আব্দুল্লাহ হাসান, আমির হোসেন, ইয়াসিন ও শাহপরান।

পাচার হয়ে যাওয়া যুবকদের স্বজনরা জানিয়েছেন, তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় দেশে ও বিদেশের জঙ্গলে মুক্তির না হয় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। কারণ ১ লাখ থেকে ৪লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে তাদের হয় গহিন জঙ্গলে হিংস্র পশুর খোরাক হতে হবে, নইলে পেট কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হবে সমুদ্রে। আর নাম প্রকাশ করলে দালালরা তাদের হত্যা করবে এটা নিশ্চিত। এদিকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা নাজমুল কিছু কথা বললেও বাকি দুজন এখনও আতঙ্কে কোনো কথাই বলছেন না। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক এই মানব পাচার চক্রের পাতা ফাঁদের প্রথম কুশীলবের ভূমিকা পালন করে মাঠ পর্যায়ের দালালরা।

তাদের মূল ও প্রধান কাজ হলো বিদেশে পাঠানোর টোপ দিয়ে শিকারকে রাজি করানো। একজন পাচার করতে পারলে মাঠপর্যায়ের দালাল কমিশন পান ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। এমন টোপে পড়া কয়েকজন যুবক জানান, আড়াইহাজারের রামচন্দ্রদীর চিহ্নিত দালাল শরীফ, পারভেজ ও সফর আলী। বেকার, কিছু জমিজমা আছে এমন যুবকরাই থাকে তাদের প্রধান টার্গেট।

নরসিংদীর সাঈদ থেকে টেকনাফের কালু সর্দার : আড়াইহাজারের এ পাচার ফাঁদের প্রধান দালালের নাম আবু সাঈদ। তার বাড়ি নরসিংদীর ফজলুরকান্দি গ্রামে। এই সাঈদের কাছ থেকে পাচারের ফাঁদে পা দেওয়া যুবকদের পাঠানো হয় টেকনাফের ভয়ংকর দালাল ও ইয়াবার কারবারি কালু দালালের কাছে। মূলত টেকনাফ, উখিয়ার গহিন অরণ্যে রয়েছে কালু সর্দারের একাধিক আস্তানা। সেখানে যাওয়ার পরপরই যুবকরা বুঝে তারা খপ্পরে পড়েছেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মালয়েশিয়া যেতে না চাওয়াদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয় লাখ লাখ টাকা।

আর যারা তার পরও যেতে রাজি হন তাদের দিতে হয় ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। তখন তাদের নেওয়া হয় সমুদ্র যাত্রায়। কালু দালালের কাছে জিম্মি আড়াইহাজারের আব্দুল্লাহ হাসানের মা ও আমির হোসেনের ভাই আলী হোসেন বলেন, দালালরা প্রতিনিয়ত আমাদের ফোন করে সাড়ে ৪ লাখ করে টাকা চাইছে। এ টাকা না পাঠালে তাদের হত্যা করা হবে। আরো জানা গেছে, চাহিদা অনুযায়ী শিকার না দিলে মাঠপর্যায়ের দালালরাও এই বড় দালালের খপ্পরে পড়ে। রামচন্দ্রদীর চিহ্নিত খুদে দালাল শরীফ, পারভেজ ও সফর আলী মানবপাচার করতে গিয়ে নিজেরাই ফাঁদে পড়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এই তিন দালালকে সম্প্রতি মিয়ানমার পাঠিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে শরীফ ফিরে এসেছেন।

নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ : এ ব্যাপারে আড়াইহাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সফর আলী কলেজের প্রভাষক মাসুম বিল্লাহ জানান, গত কয়েক বছর আগে দৈনিক যুগান্তরেই এ মানব পাচার নিয়ে তথ্যবহুল ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। উপজেলার ব্রাক্ষন্দী গ্রামের অর্ধশত নিখোঁজ যুবকের সন্ধান মিলেছিল ওই প্রতিবেদনে। এ ব্যাপারে আসলে সরকারি উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পাশাপাশি সাধারন মানুষের সচেতনার অভাব তো মূল সমস্যা।

বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগামের (অকাপ) ফিল্ড অফিসার আমিনুল হক জানান, আমরা আড়াইহাজারে মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছি। যুবসমাজকে বুঝিয়ে ওই চক্রের ফাঁদ থেকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছি।

বিশনন্দি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করব তারা যেন মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ এমদাদুল হক তৈয়ব বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আমি গ্রামবাসীদের বলব, আপনারা সতর্ক থাকুন। আপনাদের সন্তানদের এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না।


শর্টলিংকঃ