বিতর্কিতদের নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আওয়ামী লীগে


ইউএনভি ডেস্ক:

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের (আনার) কলকাতায় খুন হওয়ার পর প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। দেশের ইতিহাসে চলমান সংসদের একজন সদস্যের ভিন দেশে খুন হওয়া এবং মরদেহ খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। তবে ঝিনাইদহের টানা তিনবারের এই সংসদ সদস্যের খুনের ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আলোচিত হচ্ছে তাঁর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা এই ঘটনায় বিব্রত আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো অবস্থান নিতে পারছে না।

তবে আনোয়ারুল আজীম ছাড়াও বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের এমন বিতর্কিত অনেক সদস্য রয়েছেন বলে দলের মধ্যেও আলোচনা আছে। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য দলে নানা প্রক্রিয়া থাকলেও বিতর্কিত ব্যক্তিরা কীভাবে মনোনয়ন পান, দলটির ভেতরেই এই প্রশ্ন উঠছে। বিতর্কিতদের ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ বলছেন। তবে এসব বিষয় শেষ পর্যন্ত দল কতটা গুরুত্ব দেবে, এই সন্দেহও রয়েছে তাঁদের।

গত কয়েক দিনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। কেউ কেউ আনোয়ারুলের খুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেকেই বলছেন, তাঁরা বিব্রত। কারণ, সংসদ সদস্যের খুনের চেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সোনা চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগই বেশি আলোচিত হচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত এই সংসদ সদস্যের খুনের সুষ্ঠু বিচার ও তদন্ত চেয়ে আওয়ামী লীগ কিংবা জাতীয় সংসদ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেয়নি। দলটির সূত্র জানায়, এই খুনের ঘটনার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি কোনো বৈঠক করেনি। ১৪-দলীয় জোটের একটি বৈঠক হলেও সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। জাতীয় সংসদের অধিবেশন এখন নেই। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকেও আনোয়ারুল আজীমের বিষয়টি আলোচনায় আসেনি।

দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন, আনোয়ারুল আজীম ছাড়াও বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের এমন অনেক সদস্য রয়েছেন, যাঁদের অতীত-বর্তমান কোনোটাই সুখকর নয়। বিশেষ করে ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে দুই ডজনের বেশি বিতর্কিত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন। তাঁদের কেউ কেউ পরে বাদ পড়েছেন। কেউ কেউ এখনো রয়ে গেছেন। আর ২০১৮ ও সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বেশি প্রাধান্য পেয়েছেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রথমবার সংসদে আসা আলোচিতদের মধ্যে আরও ছিলেন ফেনীর নিজাম উদ্দিন হাজারী, নাটোরের শফিকুল ইসলাম (শিমুল), খুলনার মিজানুর রহমান, বরিশালের পঙ্কজ নাথ। এর আগের সংসদে আলোচিত হন কক্সবাজারের আবদুর রহমান ওরফে বদি, পিরোজপুরে এ কে এম এ আউয়াল, টাঙ্গাইলের আমানুর রহমান খান (রানা), ভোলার নুরুন্নবী চৌধুরী (শাওন), ঢাকার আসলামুল হক (মারা গেছেন), ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ প্রমুখ।

২০০৮ সালের পর থেকে বিতর্কিতরা এসেছেন
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, এক-এগারোর পর সংস্কারবাদী বলে পরিচিত একটা অংশ মনোনয়ন থেকে বাদ পড়লে একধরনের শূন্যস্থান তৈরি হয়। এ ছাড়া ওই নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা পক্ষের তদবির কাজ করে। ফলে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে যান। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন সহিংস রূপ নিয়েছিল। সে পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। তখন টাকাওয়ালা ও পেশিশক্তির অধিকারী অনেকে মনোনয়ন পান।

সূত্র বলছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েরও একটি অংশ রাজনৈতিক নানা আশঙ্কার কথা তুলে ধরে স্থানীয়ভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকা ও ক্ষমতাবানদের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক নেতারা পিছিয়ে পড়েন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের একটা অংশ নতুন করে মনোনয়ন পায়। এই ধারা অব্যাহত থাকে সর্বশেষ নির্বাচনেও।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এক-এগারোর আগপর্যন্ত রাজনীতিবিদদেরই প্রাধান্য ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। বিতর্কিতদেরও অনুপ্রবেশ শুরু হয়। ২০১৪ সাল থেকে এই হার আরও বেড়ে যায়। সংসদ সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে দখল, দুর্নীতি, সন্ত্রাসে মদদ, মাদক ব্যবসা, খুনখারাবি, চোরাচালানসহ নানা অভিযোগ বাড়তে থাকে।

গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আগের সংসদের ৬২ জন দলীয় সদস্য বাদ পড়েন। ২০১৮ সালে বাদ পড়েন ৩৯ জন সংসদ সদস্য। সর্বশেষ নির্বাচনে ৭১ জন বাদ পড়েন। তাঁদের জায়গায় স্থান পেয়েছেন মূলত প্রভাবশালী অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও ব্যবসায়ীরা।

 


শর্টলিংকঃ