সবচেয়ে কম মজুরি বাংলাদেশের শ্রমিকদের!


ইউএনভি ডেস্ক :

বিশ্বের সাত প্রধান তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। এমনকি গত ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েতনামের শ্রমিকদের মজুরি ও জীবনমানের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকদের তুলনামূলক এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, পোশাক শ্রমিকরা কেবল কম মজুরির কারণে একবেলার খাবার কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।

সবচেয়ে কম মজুরি বাংলাদেশের শ্রমিকদের!
ফাইল ছবি

যদিও এর কোনটিই স্বীকার করতে রাজি নন পোশাক মালিকরা। তারা বলছেন, অদক্ষ শ্রমিকের কারণে কাজ শেষ করতে সময় বেশি লাগাসহ নানা কারণে ক্রেতাদের কাছ থেকে অন্য দেশের তুলনায় কম মূল্য পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বিশ্বের সাতটি প্রধান পোশাক তৈরিকারক দেশের ন্যূনতম ও বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও আছে ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।

এদিকে বার্ষিক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থা বিবেচনায় নেওয়া হলে নতুন মজুরি কাঠামোতে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন না বেড়ে বরং ২৬ শতাংশ কমে গেছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তৈরি পোশাক খাতে চলমান উন্নতি শীর্ষক সমীক্ষার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায় যে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৯৬টি পোশাক কারখানা সচল আছে। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ, যার ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ নারী এবং ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ। প্রতিবেদন বলছে, ইতিবাচক এই উন্নয়নের পাশাপাশি এটাও অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এই ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি শোষণের বলয়ে এবং ব্যাপকহারে সস্তা পারিশ্রমিকের ওপর নির্ভর।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার , যা মোট রফতানি আয়ের (৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার) ৮৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই আয় ২০ শতাংশ বেড়েছে।

শ্রমিকের জীবন কি চলছে?

পোশাক কারখানায় কাজ করেন সরাবন। দুই সন্তান আর মাকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় উল্লেখ করে সরাবন বলেন, যখন ওভারটাইমসহ ৮ হাজার টাকা রোজগার করতাম তখনও এত কষ্ট হতো না। এখন ওভারটাইমসহ ১২ হাজার টাকা আয় করেও প্রতি মাসে ঋণ করে কাটাতে হয়। বাড়তি কিছু করার সুযোগতো নেই-ই বরং কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়।

বিশ্বের ১০টি দেশের ১ লাখ ২৩০ হাজার মানুষের ওপর করা জরিপে অক্সফাম বলছে, জীবনযাপনের জন্য যে অর্থ দরকার, তার চেয়ে অনেক কম অর্থ পান বাংলাদেশের শ্রমিকেরা। ‘রিওয়ার্ড ওয়ার্ক, নট ওয়েলথ’ নামের এ প্রতিবেদন গতবছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনে বিপুল সম্পদ সৃষ্টি এবং এসব সম্পদ যেসব মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত হয়, তাঁদের দারিদ্র্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অক্সফাম এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে দেশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জীবনমানের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

অক্সফামের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বসবাসের জন্য শোভন মজুরি প্রয়োজন ২৫২ মার্কিন ডলারের সমান অর্থ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক পান ৫০ ডলার। ভারত ও শ্রীলংকার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫০ ডলার। তবে ভারতে শোভন জীবনযাপনের জন্য ২০০ ডলার এবং শ্রীলংকায় ২৫০ ডলারের বেশি অর্থ দরকার হয়।

খাদ্য সংকট, সন্তানকে দূরে রাখতে বাধ্য হচ্ছে

অক্সফামের গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন সাক্ষাৎকারদাতার একজন জানিয়েছেন তাদের সন্তান গ্রামে রাখতে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ৮০ শতাংশই বলছেন কম মজুরির কথা। শতভাগ শ্রমিক বলছেন, তাদের জীবনমানের চেয়ে কম মজুরি পান তারা। ভিয়েতনামের মতো দেশে মজুরি কম পাওয়া শ্রমিকের পরিমাণ ৭৪ শতাংশ।

মেইড ইন পোভার্টি: দ্য ট্রু পিস অব ফ্যাশন শিরোনামে গবেষণায়  অস্ট্রেলিয়া, বিলস ও ভিয়েতনামের ট্রেড ইউনিয়ন বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ৪৭০ জন শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় অক্সফাম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমনকি ৯৯ শতাংশকর্মীকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। ৫৫ শতাংশ তিনঘণ্টারও বেশি সময় ওভারটাইম করে।

অক্সফাম অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা বলছে, বেশিরভাগ শ্রমিক তিনবেলা ভরপেট খাবার সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে। দশজনে নয়জনই বলছেন, তারা তাদের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য যথেষ্ট খাবার সংস্থান করতে পারছেন না এবং একবেলা খাওয়া এড়িয়ে যেতে হচ্ছে কখনও কখনও।

টিআইবি যা বলে

প্রধান পোশাক রফতানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে টিআইবি। জিডিপি পার ক্যাপিটা প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় কম্বোডিয়ার সঙ্গে তুলনা করে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি যেখানে ১০১ ডলার সেখানে কম্বোডিয়ায় ১৯৭। তারা এও বলছে, পোশাক শ্রমিকদের বেতন না বেড়ে বরং ২৬ শতাংশ কমে গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে গ্রেড-১ শ্রমিকদের মূল মজুরি ছিল সাড়ে আট হাজার টাকা এবং গত জানুয়ারিতে ঘোষিত নতুন সংশোধিত মজুরি কাঠামোতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৩৮ টাকা। কিন্তু পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বিবেচনায় নেওয়া হলে তা হতো ১৩ হাজার ৩৪৩ টাকা। অর্থাৎ, ইনক্রিমেন্ট যোগ না করায় বেতন দুই হাজার ৪০৫ টাকা কমে গেছে।

তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এই প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে বলেন, আমাদের এখন তেমন খারাপ পরিস্থিতি নেই। আমাদের দক্ষতা কম, চীন যে সময়ে যে পরিমাণ পণ্য প্রস্তুত করে আমাদের সেটাতে তিনগুণ বেশি সময় লাগে। প্রতিযোগী দেশগুলোর একজন শ্রমিকের জায়গায় আমাদের তিনজন শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। ফলে মজুরি কমে।

টিআইবি প্রতিবেদন বিষয়ে তিনি আরও বলেন, যে সেক্টরের ওপর গবেষণা সেই সেক্টরের কাছ থেকে তথ্য নিতে হয়। যারা তা করে না তারা দেশের ক্ষতি করতে চায় কিনা সেই সন্দেহ রয়েই যায়।

এদিকে টিআইবির এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সঙ্গে জড়িত নাজমুল হুদা মিনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিবারই এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় এবং মালিকসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আমরা বসি। এবারও আমরা বিজিএমইএ এর সঙ্গে বসতে চেয়েছি কিন্তু তারা তাদের নির্বাচনসহ নানা বিষয় দেখিয়ে আমাদের সাথে বসেনি। কেন কম্বোডিয়ার সাথে বাংলাদেশের তুলনামূলক আলোচনা করা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু তাদের জিডিপি পার ক্যাপিটা আমাদের কাছাকাছি অথচ শ্রমিকের মজুরি আমাদের চেয়ে প্রায় একশ ডলার বেশি সেহেতু তাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শ্রমিকদের মজুরি এবার বেতন বাড়লে অন্যদের সমান হবে বলে মনে করে মালিকরা আরেকটা ভুল করছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তখন সেইসব দেশের মজুরি আরও বাড়বে। ফলে আমাদের অবস্থান আগের মতোই থাকবে।

কম দক্ষ শ্রমিকের কারণে তাদের পেছনে খরচ বেশি হওয়ায় মজুরি কম হয় এমন যুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শ্রমিকের খরচ কম বলেই বায়াররা বেশি আগ্রহ নিয়ে মালিকদের কাজ দেয়। দেশি মালিক ও বিদেশি মালিক উভয়েই অধিক মুনাফা চায়। শ্রমিকদের কত সস্তায় খাটায়ে নিতে পারে সেটাই মূল টার্গেট। তাদের মুনাফার বলি আমাদের শ্রমিকরা। রফতানির জায়গা থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ কিন্তু যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ তাদের মজুরিও আমাদের চেয়ে বেশি। বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি কোনওবারই হয়নি। তথ্যসূত্র : বাংলা ট্রিবিউন


শর্টলিংকঃ