সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড়


ইউএনভি ডেস্ক:

কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। শুক্রবার রাতে কোনো একসময় ভাস্কর্যটির ডান হাত, পুরো মুখ ও বাম হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলা হয়। এর প্রতিবাদে শনিবার বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, মশাল মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন সংগঠন।

এসব কর্মসূচি থেকে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্ত প্রতিহত করতে লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দেয়া হয়। তবে ভাস্কর্য নিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে সবাইকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেখছেন।

ঢাকায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী দলের বিরোধিতার মধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনা ঘটল। এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় ভাস্কর্যটির সামনে মাইক্রোবাস থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

মাঠে থাকার ঘোষণা আওয়ামী লীগের : বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে লাগাতার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো। এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ যুবলীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন ঢাকাসহ সারা দেশে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম যুগান্তরকে বলেন, জাতির পিতার ভাস্কর্যের ওপর যারা আঘাত হানার দুঃসাহস দেখায়, তাদের প্রতি আমরা ঘৃণা জানাচ্ছি। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। এ ঘৃণ্য অপশক্তিকে আমরা যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করব। তাদের মূলোৎপাটন করা হবে।

গৌরব ’৭১-এর ‘মহাসমাবেশ’ : রাজধানীর শ্যামপুরের দোলাইরপাড় উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মহাসমাবেশ করেছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গৌরব ’৭১। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়ায় মামুনুলদের প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

এ সময় জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাছির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, শহীদসন্তান নুজহাত চৌধুরী শম্পা, শমি কায়সার, ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্মল রোজারিও, আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বাবু নির্মল রঞ্জন গুহ এবং সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, একেএম শামীম ওসমান চৌধুরী এমপি ও নিক্সন চৌধুরী এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গৌরব ’৭১-এর সভাপতি এসএম মনিরুল ইসলাম মনি এবং সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এফএম শাহীন।

শহীদ মিনারে মানববন্ধন : বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দিয়ে তা রুখতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব রাজনৈতিক শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন কর্মসূচিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত মানববন্ধনে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট ঢাকা কেন্দ্র, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ও বাংলাদেশ যাত্রাশিল্পী উন্নয়ন পরিষদের সদস্যরা অংশ নেন।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, রাজনীতি নিয়ে আমাদের মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কারও ভিন্নমত থাকা উচিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও একাত্তরের আদর্শের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে ১১ ডিসেম্বর সব উপজেলায় প্রতিবাদী মানববন্ধন করা হবে।

মামুনুল-ফয়জুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ : ভাস্কর্যের বিরোধিতার নামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চের নেতারা জানান, রোববার আদালতে মামলা করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আল মামুন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছে মৌলবাদী অপশক্তি মামুনুল ও ফয়জুল। কিছুদিন আগে এ হুমকি দেয়া হয়। আল মামুন বলেন, দেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।

একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বলাৎকারের ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র আগামী বুধবার বিকাল ৪টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রদর্শন করা হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বলাৎকারের প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা দেশের সব মসজিদে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে।

ঢাবিতে মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সন্ধ্যা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিনিধি জানান, ধর্ম ব্যবসায়ী ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে মশাল জ্বালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকতের উদ্যোগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) চত্বরে এ ভিন্নধর্মী প্রতিবাদের আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে আলেম সমাজের একটি অংশের বিরোধিতার জেরে এ প্রতিবাদের আয়োজন করা হয়। এ সময় গান, কবিতা ও বক্তৃতার মাধ্যমে ভাস্কর্য নির্মাণে বিরোধিতাকারীদের প্রতি নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। এর আগে মশাল জ্বালানোর মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

মহানগর আওয়ামী লীগ : বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে সন্ধ্যায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এ সময় দক্ষিণের সভাপতি আবু আহম্মাদ মন্নাফিসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। রাজধানীর ধানমণ্ডির ৩/এ-এর দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়। সংগঠনের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এসএ মান্নান কচিসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

যুবলীগ : বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে যুবলীগ। সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগান জামে মসজিদের সামনে থেকে সংগঠনটির একটি মিছিল শুরু হয়ে ধানমণ্ডি-৩২ এ গিয়ে শেষ হয়। এ সময় সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, মঞ্জুর আলম শাহীন, মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপি, তাজউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বাস মতিউর রহমান বাদশা, সুব্রত পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে আজ সারা দেশে প্রতিটি জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসভায় (সব মহানগরের অন্তর্গত প্রতিটি ওয়ার্ড) সারাদিন রাজপথে অবস্থান এবং বিকাল ৩টায় একযোগে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করবে সংগঠনটি।

কৃষক লীগ : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগ। কৃষক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ ও সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলছুম স্মৃতির নেতৃত্বে সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিলটি অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে শুরু হয়ে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

মৎস্যজীবী লীগ : রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ। বিকালে সংগঠনের সভাপতি সাইদুর রহমান সাইদ, কার্যকরী সভাপতি সাইফুল আলম মানিক ও সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখ আজগর নস্করের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

ছাত্রলীগ : কুষ্টিয়ায় রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ। সন্ধ্যায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যসহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

যুব মৈত্রী : বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আস্ফালন ও দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সংগঠনের সভাপতি সাব্বাহ আলী খান কলিন্সের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্যের ডান হাত, পুরো মুখমণ্ডল ও বাঁ হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। শনিবার সকালে এ ঘটনা জানাজানি হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ ও জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন করে। ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়।

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন ও পুলিশ সুপার তানভির আরাফাতসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, পৌরসভার উদ্যোগে শহরের প্রাণকেন্দ্র পাঁচ রাস্তার মোড়ে গত মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

একই বেদিতে বঙ্গবন্ধুর তিন ধরনের তিনটি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এছাড়া একই বেদিতে জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্যও থাকবে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। তিনি জানান, শনিবার রাতে দুর্বৃত্তরা ভাস্কর্যটির ডান হাত, পুরো মুখমণ্ডল ও বাঁ হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলেছে।

ভাস্কর মাহাবুব জামান শামীম জানান, ভাস্কর্যটি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতীক। যারা এটি ভাঙার দুঃসাহস দেখিয়েছে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, রাতের আঁধারে যারা এ অপকর্ম করেছে তারা কাপুরুষ। এ ঘটনায় জড়িতদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। যারাই এ ভাস্কর্য ভাংচুরের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পুলিশ সুপার এসএম তানভির আরাফাত জানান, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক কারশেদ আলম জানান, এটি খুবই গর্হিত অপরাধ। মৌলবাদী অপশক্তি এসব করে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

মানববন্ধনে জেলা জাসদের সভাপতি হাজী গোলাম মহসিন বলেন, সারা দেশের ভাস্কর্য অপসারণের যুক্তি দিয়ে বিভিন্ন মসজিদের জুমার খুতবায় মুসল্লিদের উস্কে দেয়ার খবর পেয়েছি। এরপরই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করা হয়।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে বের করা মিছিল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালায়। এ সময় কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল ভাংচুর করা হয়। জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী বলেন, কোনো ভাংচুরের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মী জড়িত নেই। অথচ বিএনপি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়েছে।

ভাস্কর্যের সামনে ফাঁকা গুলি : শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শহরের ব্যস্ততম এলাকা পাঁচরাস্তা মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে মাইক্রোবাসে এসে এক যুবক পুলিশের উপস্থিতিতে পিস্তল উঁচিয়ে দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এরপর দ্রুত মাইক্রোবাসে মজমপুর গেট দিয়ে চৌড়হাঁসের দিকে যুবকটি চলে যায়। ঘটনাটি পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক (এসআই) মকছেদুর রহমান প্রত্যক্ষ করেন। তবে তিনি তাকে আটকাতে পারেননি। ভাস্কর্য এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এসআই মকছেদুর বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটি নোয়াহ গাড়ি আসে। ওই গাড়ির ভেতর থেকে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। গাড়িটিতে কোনো নম্বর প্লেট ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

বিএফইউজে-ডিইউজের প্রতিবাদ : কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনায় গভীয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ এবং ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু শনিবার এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরনের অপতৎপরতা কোনোভাবেই বরদাশত করবে না সাংবাদিক সমাজ। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। এর মদদদাতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

তারা আরও বলেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কখনও গণমাধ্যমের সহায়ক শক্তি হতে পারে না। এরা সৃজনশীল উদ্যোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনা কোনো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ করতে পারে না। সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির অপকৌশল হিসেবে চিহ্নিত মহল এই অপতৎপরতায় মেতে উঠেছে। এদের শক্ত হাতে দমন করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ চায় সাংবাদিক সমাজ। এদিকে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে আগামী ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ কুষ্টিয়ায় মজমপুর চৌরাস্তায় বঙ্গবন্ধু চত্বরে সাংবাদিক-গণসমাবেশ হবে। নেতারা ওই সমাবেশ সফল করতে সাংবাদিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

যশোর ব্যুরো জানায়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঔদ্ধত্য দেখানো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে যশোরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। শনিবার যশোর শহরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের উদ্যোগে পৃথক কর্মসূচি পালন করা হয়। ফরিদপুর ব্যুরো জানায়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে ফরিদপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। শনিবার সন্ধ্যায় জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্থানীয় আলিপুর মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক ভোলা মাস্টার, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামীম হক।


শর্টলিংকঃ