৩৭০ ধারা বিলোপ : বঞ্চানার শেষে আশার আলো


ইউএনভি ডেস্ক:

জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য ঐতিহাসিক দিন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারতের জাতীয় সংসদে ঘোষিত হয়, গঠিত হবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দুভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ দুটি পৃথক কেন্দ্রীয়শাসিত অঞ্চল হিসাবে। সেই মতো সরাসরি কেন্দ্রের শাসনে শুরু হলো নতুন অধ্যায়। উন্নয়নকেই দেওয়া হলো সেই অধ্যায়ের নতুন আঙ্গিক।

রাজ্যের মানুষদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে সামাজিক ও আর্থিক সংস্কারের নয়া অধ্যায় শুরু হলো। অপপ্রচারের মধ্যেই স্থানীয় মানুষ পেতে শুরু করলেন গোটা দেশের সাধারণ মানুষদের মতো অভিন্ন নাগরিক অধিকার।

আসলে বিভিন্ন ঘচটনা প্রভাহ প্রমাণ করছে ৩৭০ ধারাই ছিল কাশ্মীরের প্রকৃত উন্নয়নের পরিপন্থী। তাই এই ধারাটি লোপ পেতেই শুরু হয়েছে সার্বিক উন্নয়ন ও উপত্যকার শ্রীবৃদ্ধির জোয়ার। মানুষ স্বাক্ষী হতে পারছেন বিকাশের। রাষ্ট্রের শ্লোগান, সবার সাথে, সবার বিকাশ, সবার বিশ্বাস। তাই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কাশ্মীরও সেই এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত যাত্রার শরিক। আর বিভিন্ন ঘটনা প্রভাহে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে উন্নয়নের নিরিখে। ৩৭জ রদ হওয়ার পর থেকেই অভূতপূর্ব উন্নয়ন শুরু হয়েছে বিভিন্ন দিক থেকে। জম্মু ও কাশ্মীর পৃথক রাজ্য থাকার সময় বহু মানুষ ছিলেন বঞ্চনার শিকার। বৈষম্য ছিল পদে পদে। পিছলে বর্গের মানুষ ছিলেন অমানবিক পরিস্থিতির শিকার। তাঁদের সামান্য অধিকারটুকুও ছিলো না ৩৭০ ধারা চালু থাকার সময়। তাঁদেরকে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ভারতের উন্নয়ন কর্মসূচির বহু সুবিধাই পৌঁছাতো না তাঁদের কাছে। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও ন্যূনতম সম্মানটুকুও জোটেনি প্রান্তিক মানুষদের। প্রতিবন্ধক হয়েছিল ৩৭০ ধারা। বিলোপ হতেই সকলের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আগে জম্মু ও কাশ্মীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে মহিলারা ছিলেন একরকম বঞ্চিতই। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন ছিলো একপেশে। সেখানকার মহিলারা রাজ্যের বাইরে কাউকে বিয়ে করলে সমস্ত সম্পত্তির অধিকার হারাতেন। নারী স্বাধীনতা বলে কিছু ছিলো না। ভিন রাজ্যে বিয়ে করলে নাগরিকত্বও খোয়াতে হতো কাশ্মীরি মহিলাদের। ৩৭০ ধারা বিলোপের ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন কাশ্মীরের মহিলারা। তাঁদের কালা কানুনের দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘটেছে। নয়া কেন্দ্র শাসিত রাজ্যে তাঁরা পাচ্ছেন পুরুষদরে সমান মর্যাদা। ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির পর মহিলাদের আর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। তাঁদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। ভিন রাজ্যে বিয়ে করলেও কেই তাঁদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারবেনা।


আগে ৩৫-এ ধারা বলে জম্মু ও খাশ্মীরের সরকারই ঠিক করতে কারা কারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। সেইমতো দেওয়া হতো পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট বা পিআরসি। স্থায়ী বাসিন্দার এই শংসাপত্র না থাকলে সরকারি কোনও সুবিধাই জুটতো না। সরকারি চাকরি থেকে জমি-বাড়ি কেনা-বেচা, সবকিছুতেই জরুরি ছিলো পিআরসি। আর এই পিআরসি ছিলো সরকারের মর্জিনির্ভর। পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীরা বহু বছর ধরে বঞ্চিত ছিলেন নাগরিকত্ব থেকে। তাঁদের পিআরসি দেওয়া হতো না। একই রকম ভাবে ১৯৫৩ সাল থেকে কাশ্মীরে স্যানিটেশন কর্মীরা রাজ্যবাসীর স্বার্থে কাজ করে গেলেও তাঁরা পাননি পিআরসি। বঞ্চিত করা হয় নাগরিকত্বের অধিকার থেকে। এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষই চাকরি তো দূরঅস্ত, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনো করার অধিকার থেকেও ছিলেন বঞ্চিত। কিন্তু ৩৭০ ধারা বিলোপ তাঁদের জীবনে নিয়ে এসেছে নতুন করে আশার আলো। তাঁরাও নাগরিক হিসাবে সমস্ত সুবিধা পাওয়ার অধিকারি। সবধরনের বঞ্চমনার অবসান ঘটিয়ে ভারত সরকার তাঁদেরকেও খুশি করতে পেরেছেন। বহুদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থী-সহ কাশ্মীরের বহু স্থায়ী বাসিন্দারা নাগরিকত্ব বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। তাঁদের দাবি মানা হচ্ছিলো না। ৩৭০ ধারা বিলোপ করে সরকার তাঁদের ন্যায্য অধিকারকে সম্মান জানিয়েছে।

বিতর্কিত ৩৭০ ধারা বিলোপ হতেই অবসান ঘটতে চলেছে তাঁদের সব ধরনের বঞ্চনার। নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সকলের জন্য। শিক্ষা থেকে চাকরি, সবকিছুরই অধিকার পাবেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা। অতীতে সেটা তাঁদের কাছে ছিলো স্বপ্নমাত্র। সেই স্বপ্নকেই বাস্তব করেছে বর্তমান সরকার। এখন থেকে তাঁরা শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধাও পাবেন। অর্থাত এসসি বা এসটি সম্প্রদায়ের জন্য যেসব সুবিধা রয়েছে সেই সুবিধা থেকে তাঁদের বঞ্চনার যুগ শেষ হতে চলেছে। ভারতের অন্যান্য নাগরিকদের মতো তাঁরাও পেতে চলেচেন সবধরনের সুবিধা।

এক সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষরা এখন সম অধিকার পাচ্ছেন উপত্যকার অন্য নাগরিকদের মতোই। কেন্দ্রশাসিত জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ হতেই তাঁদের সামনে খুলে গিয়েছে সরকারি পরিকাঠামোয় শিক্ষার পাশাপাশি সরকারি চাকরির দরোজা। ফলে যুবকদের মনে সঞ্চারিত হয়েছে নতুন করে আশার আলো। তাঁরা নিজেদের পছন্দ মতো পেশা বেছে নিতে পারবেন। পারবেন সরকারি চাকরিতে যোগ দিতেও। ভোগ করবেন উপত্যকার অন্য যুবাদের মতোই সম অধিকার।

আসলে ৩৭০ ধারা বিলোপ পশ্চিম পাকিস্তান তেকে আসা শরণীর্থীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নানা দিক খুলে দিয়েছে তাঁদের সামনে। এখন তাঁরা প্রথমবারের মতো নিজেদের পুরোপুরি ভারতীয় ভাবতে পারছেন। সম অদিকারের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পেয়ে তাঁরা দীর্ঘদিনের হীনমন্যতা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। নিজেদের ঠিকানায় তাঁদের সামনে পৌঁছে গিয়েছে সমতার বার্তা। এখন তাঁদের নিজেদের নতুন করে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। ভারতের প্রতিটি নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থী যুবকরাও পৌঁছাতে পারবেন উন্নয়নের শিখরে। নতুন প্রজন্মের কাছে এসেছে দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে নতুন করে নিজেকে তৈরি করার সুযোগ। এখন তাঁরা ডানা মেলে উড়ে যেতে পারবেন নিজেদের তৈরি করার যজ্ঞে। সুযোগ এখন তাঁদের দখলে। স্বপ্নপূরণে ইচ্ছাডানারা পেয়েছে উড়বার আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত আকাশ।

৩৭০ ধারা বিলোপের আগে জম্মু-কাশ্মীরে ভিন রাজ্যের বাসিন্দারা কেউ সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। বছরের পর বছর কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও তাঁদের ছিলো না কোনও বাড়ি বা জমি কেনার অধিকার। আইনি বেড়া জালে আটকে ছিলো বহু দশক ধরে কাশ্মীরে বসবাসকারীদের সম্পত্তির অধিকার। নতুন জমি কেনার কোনও সুযোগই ছিলো না আগে। এখন সেই বঞ্চনার যুগ শেষ। নতুন করে তাই কাশ্মীরের বহু স্থায়ী বাসিন্দারা নিজস্ব বাড়ি-ঘরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। মিলেছে পরবাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি।


ভিন রাজ্য থেকে আসা স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য সম্পত্তি কেনায় ৩৭০ ধারার প্রতিবন্ধকতার বিরূপ প্রভাব পড়ছিল সমাজ জীবনে। বহুকাল ধরে এখানে বসবাস করেও তাঁরা কিছুতেই একাত্ম হতে পারছিলেন না স্থানীয়দের সঙ্গে। তাই ভিন রাজ্য থেকে এসে পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে তাঁরা পেশাগত দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে স্থায়ীবাবে বসবাসের কথা ভাবতে পারতেন না। সবসময়ই তাঁদের রাজ্য ছাড়ার বাসনা কাজ করতো। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি মোটেই সমাজের উন্নয়নের পক্ষে ভালো নয়। রাজ্যের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির পক্ষেও ক্ষতিকারক। কারণ রাজ্যে ব্যবসা-বানিজ্য বা অন্য কোনও ফরায়ে অর্থ উপার্জনের পর সেই অর্থ যদি ভিন রাজ্যে চলে যায় তবে সেটা অর্থনীতির পক্ষেও মঙ্গলজনক নয়।

এছাড়াও ৩৭০ ধারা রক্ষাকবচের শক্তিতে কাশ্মীরের কঠোর ভূমি আইন রাজ্যের উন্নয়নের প্রতিবন্ধকা সৃষ্টি করেছিল। বিনিয়োগ আসছিলো না। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে পিছিয়ে পড়ছিল রাজ্যটি। দেশের উন্নয়নের মহাসড়কে সামিল হতে পারছিলেন না তাঁরা। কারণ বিনিয়োগের পক্ষেও তো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল ৩৭০ ধারা। ছিলো না সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার। এখন সেই আইনও প্রতিষ্ঠিত হবে। বিনা পয়সায় প্রান্তিক ও বঞ্চিত শিশুরাও পাবে বিনা পয়সায় গুণগত শিক্ষা। সঙ্গে থাকবে পুষ্ঠিকর খাবারের জন্য মিড-ডে মিল। এসসি বা এসটি সম্প্রদায় পাবে শিক্ষা ভাতাও। চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

৩৭০ ধারা বিলুপ্তি সবদিক থেকেই কাশ্মীরের উন্নয়নে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। অবসান ঘটছে মানুষের অমানবিক বঞ্চনার। নতুন নতুন সম্ভাবনার দরোজা খুলে দিয়েছে। মহিলারা পাচ্ছেন নতুন করে মাথা উঁচু করে জীবন যাপনের অধিকার। প্রান্তিক মানুষরা পেতে চলেছেন নাগরিকত্বের মৌলিক অধিকার। আর অশান্ত কাস্মীর উপত্যকার যুবকদের সামনে খুলে গেলো জীবিকার সর্বোচ্চস্তরে পৌঁছানোর হাতছানি। এখন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতোই জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত রাজ্যটিও পাচ্ছে নিজেদের আত্মনির্ভর করে তোলার সুবর্ণ সুযোগ। আর কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সরাসরি উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে রাজ্যে। সবদিক থেকেই আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে ৩৭০ ধারা বিলোপ।


শর্টলিংকঃ