অন্যের জমিতে আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রতারণা, নেপথ্যে প্রভাবশালী নেতার স্ত্রী


নিজস্ব প্রতিবেদক: 

সরকারি অনুমোদন নেই। জমি কেনা হয়নি এখনও। তারপরেও অন্যের জমি নিজেদের হিসেবে দেখিয়ে রাজশাহীতে প্লট বুকিং শুরু করেছে উত্তরায়ণ আমানা সিটি লিমিটেড। কোম্পানিটি তাদের এই প্রকল্পের নকশায় সাড়ে ৬ হাজার বিঘা জমির কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবে তারা সামান্য কিছু জমি কিনে রাজশাহী সিটি হাট এলাকায় প্রকল্পের সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। সরকারি নিবন্ধন অনুযায়ী, এই যৌথমূলধনী কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার স্ত্রী।

অন্যের জমিতে আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রতারণা, নেপথ্যে প্রভাবশালী নেতার স্ত্রী

সিটি হাট এলাকার যাদের জমি নকশায় দেখিয়ে উত্তরায়ণ আমানা সিটি প্লট বুকিং শুরু করেছে, তাদের অভিযোগ, স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাদের জমি দখলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে কোম্পানিটি। ইতোমধ্যে জমির প্রকৃত মালিকরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছে। তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সম্প্রতি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-রাজশাহীর পক্ষ থেকে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কাছে উত্তরায়ণ আমানা সিটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে রাজশাহীতে আমানা গ্রুপ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা ইভ্যালি, ডেসটিনি, যুবক, এহসান ইত্যাদি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহীতে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা বিনিয়োগের নামে প্রতারণা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বিষয়গুলো অনতিবিলম্বে তদন্ত করে যথোপযুক্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছে ক্যাব।

স্মারকলিপিতে ক্যাব আরও বলেছে, ৭ ফেব্রুয়ারি মহান জাতীয় সংসদে সংসদ নেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে কোনো তিন ফসলি জমি নষ্ট করে কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বা আবাসন সৃষ্টি করা যাবে না। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সভায় একই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করার জন্য দেশের সব ডেপুটি কমিশনারদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাজশাহীতে আমানা গ্রুপ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘উত্তরায়ণ আমানা সিটি’ নামে একটা আবাসন প্রকল্পের কাল্পনিক ম্যাপ বা নকশা তৈরি করে প্রায় ছয় হাজার বিঘা জমি দেখাচ্ছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই ছয় হাজার বিঘা জমির সিংহভাগই তিন ফসলি জমি, কোনোটি আবার দুই ফসলি।

এই ছয় হাজার বিঘা জমিকে কেন্দ্র করে বা দেখিয়ে যে আবাসন প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেই জমির অধিকাংশ মালিকই জানেন না, কীভাবে আমানা গ্রুপ তাঁদের জমিকে অন্তর্ভুক্ত করে কথিত আবাসন প্রকল্পের নামে জমি বিক্রি করছে। এদিকে যেসব গ্রাহক উত্তরায়ণ আমানা সিটি আবাসন প্রকল্পের নামে শুধু নকশা দেখেই প্লট বুকিংসহ মাসে মাসে কিস্তি প্রদান করছেন, তাঁরা প্রতারিত হবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ক্যাব। ক্যাবের অভিযোগে আরও বলা হয়, কোম্পানি থেকে প্রতারিত হতে পারেন এমন আশঙ্কায় অনেক গ্রাহক জমি বুকিংয়ের অর্থ ফেরত চাইলেও উত্তরায়ণ আমানা সিটির পক্ষ থেকে তাদের টাকা ফেরত না দিয়ে ঘোরানো হচ্ছে।

জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হ‌ুমায়ূন কবীর বলেন, ক্যাবের একটি স্মারকলিপি পেয়েছেন। তিনি জেলা প্রশাসককে তদন্তের জন্য একটি নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রকল্পের নেপথ্যে প্রভাবশালী নেতার পরিবার

জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধনের নথিপত্র অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালে উত্তরায়ণ আমানা সিটি লিমিটেড নিবন্ধন পায়। কোম্পানির নিবন্ধন নম্বর ১৩০৭। নিবন্ধনের নথিপত্র অনুসারে, উত্তরায়ণ আমানা সিটি নিবন্ধনকালে যাকে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করে, তিনি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার স্ত্রী। তিনি নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় মাত্র ১০০ বিঘা ফসলী জমি কেনা হয়েছে উত্তরায়ণ আমানা সিটির পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিমের নামে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উত্তরায়ণ আমানা সিটি তাদের কাছ থেকে প্লট বুকিংয়ের টাকা নিয়েছেন ওই রাজনৈতিক নেতা ও তার স্ত্রীর নাম উল্লেখ করেই। ওই চিকিৎসক আরও জানান, বুকিংয়ের আগে তিনি ও তার আরেকজন চিকিৎসক বন্ধু ওই নেতার কাছে মতামতও চেয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে প্লট কিনতে উৎসাহিত করে বলেছিলেন যে, এই প্রকল্পের সঙ্গে তিনি আছেন। এতে কোনো সমস্যা নেই।

প্রকল্পের নকশায় সাড়ে ৬ হাজার বিঘা জমি দেখিয়ে আমানা গ্রুপ প্লট বিক্রি করছে। রাজশাহী মহানগরীর ষষ্ঠিতলা এলাকার জাকির খান জানান, সেই নকশায় তিনি দেখেন যে, তাঁর দুটি প্লট এর মধ্যে পড়েছে। একটি ১০ কাঠা ও অপরটি ১৪ কাঠার। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর প্রতিবাদ করেছেন। পরে আমানা গ্রুপকে একটি উকিল নোটিশ পাঠান। জবাবে গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, বাজারমূল্যে তারা তার প্লট দুটো ক্রয় করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আর কোনো যোগাযোগও তারা করেনি। জাকির খানের আশঙ্কা, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে উত্তরায়ণ আমানা সিটি তার এই দুটি প্লট জবর দখল করতে পারে। এর বাইরে তার বাবার নামের একটি ১০ কাঠা জমিও একই পরিস্থিতিতে আছে বলে জানান জাকির খান।

রাজশাহীতে আমানা গ্রুপের জমি কেনাসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করেন কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ আনোয়ারুল কাদির।তিনি দাবি করেন, কারও জমি তাঁরা জোর করে দখল করেননি। যেটুকু কিনেছেন, বাজারমূল্যের চেয়ে একটু বেশি দাম দিয়েই কিনেছেন। যেসব জমি প্রকল্পের মানচিত্রে দেখানো হয়েছে, এসব তাঁদের প্রকল্প সম্প্রসারণের ‘মাস্টারপ্ল্যান’-এর অংশ বলে উল্লেখ করেন। আনোয়ারুল কাদির আরও জানান, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সীমানা বৃদ্ধি করা হবে। তখন সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পও থাকবে তাদের এই আবাসন প্রকল্পকে কেন্দ্র করে।

আরডিএর অনুমোদন নেই, জমির শ্রেণিও অপরিবর্তিত

রাজশাহী সিটি হাট সংলগ্ন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি জায়গায় ফসলি জমির মধ্যে বড়সড় আকারে উত্তরায়ণ আমানা সিটির সাইনবোর্ড টানানো। রাজশাহী বাইপাস থেকে উত্তরে টানা বায়া পর্যন্ত বিস্তৃত এই মাঠ। স্থানীয় কৃষক রইসুল জানান, উত্তরায়ণ আমানা সিটি এই বিস্তৃত মাঠের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জমি কিনে, সেখানে টানিয়ে দিয়েছেন নিজেদের সাইনবোর্ড। এতে দেখতে মনে হয়, এই পুরো বিস্তৃত জমিই তারা কিনে নিয়েছে। তিনি দাবি করেন, তিন ফসলি এই জমিগুলোকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। এখন হুট করে এখানে আবাসন প্রকল্প হলে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হ‌ুমায়ূন কবীর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুসারে তিন ফসলি জমিতে অন্য কোনো কিছু করা যাবে না। সেক্ষেত্রে আবাসন প্রকল্প করতে হলে আগে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে হবে, ফসলি জমির ক্ষেত্রে যার সুযোগ নেই। এছাড়া আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে হলে রাজশাহীতে আরডিএর পূর্বানুমতির প্রয়োজন রয়েছে। সেই অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রকল্প করা যাবে না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, এখনো পর্যন্ত রাজশাহীতে বেসরকারি কোনো আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য তাদের পক্ষ থেকে কাউকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। সেই হিসেবে এতোবড় আবাসন প্রকল্প কেউ করতে পারে না। তাহলে উত্তরায়ণ আমানা সিটি এই প্রকল্প করছে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আরডিএ চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়টি আমরা দেখবো।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, উত্তরায়ণ আমানা সিটির পক্ষ থেকে অনেক আগে সিটি হাট এলাকায় জমি কেনার অনুমোদন চাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে আবাসন প্রকল্প তৈরির কোনো কথা ছিলো না। এমনকি ওইসব এলাকার ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তনও করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেন তিনি। ক্যাবের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করে দেখছি।

এ বিষয়ে জানতে রাজশাহীর সাগরপাড়ায় অবস্থিত উত্তরায়ণ গ্রুপের কার্যালয়ে গেলে সেখান থেকে জানানো হয়, এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন শুধু তাদের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গ্রুপের চেয়ারম্যান ও উত্তরায়ণ আমানা সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল করিমের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এসএমএস দিলেও কোনো উত্তর মেলেনি।

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হ‌ুমায়ূন কবীর বলেন, ‘যত বড় মানুষের কোম্পানিই হোক না কেন, গ্রাহকরা প্রতারণার শিকার হলে তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। উত্তরায়ণ আমানা সিটির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেগুলো যদি তদন্তে প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


শর্টলিংকঃ