ঈদ শেষে আমচাষিদের ঘরে এলো ‘ঈদ’!


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ইয়াকুব আলী। বছরের ছয় মাস বাড়িতে থাকেন। বাকি ছয় মাস বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে কাজ করেন। যে ছয়/সাত মাস বাড়িতে থাকেন, সেটা আমের মৌসুমে। নিজের আম বাগান মাত্র ১০ কাঠা জমিতে। লিজ নিয়েছেন চার বিঘা। তার বাগানের গাছে আম বলতে খিরসাপাত, ল্যাংড়া আর আম্রপালি।

জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২৮ মে থেকে রাজশাহীতে খিরসাপাত আম পাড়া শুরু হয়েছে। আর ল্যাংড়া নামানো যাচ্ছে ৬ জুন থেকে। তবে ইয়াকুব আলী এখনও পর্যন্ত মোটে তিন মণ আম বিক্রি করেছেন হাটে। গত ১/২ জুন থেকে তার বাগানের গাছে খিরসা আমে পাক ধরেছে। তবুও তা পাড়েননি ইয়াকুব আলী। কারণ হিসেবে জানালেন- ঈদের আগে আমের দাম না পাওয়ার শঙ্কার কথা।

ঈদ উৎসব শেষ, দুই/চার দিনের মধ্যেই গাছ থেকে সব খিরসাপাত নামিয়ে বাজারজাত করতে হবে ইয়াকুব আলীকে। দাম ভালো পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ইয়াকুব লিজ নেওয়া বাগানে বসেই আম পাড়ার জালতা বা টুসি মেরামত করতে করতে বলেন, ‘গত দু’তিন বছর ঈদের মধ্যেই পড়ছে আম নামানোর ডেট (তারিখ)। মহা মুসিবত! গাছে আমে পাক ধরে যায়, কিন্তু বাজারে ভালো দাম না থাকায় নামানোও যায় না। ঈদও মাটি হয়, সঙ্গে লোকসানও গুণতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই যে ঈদটা গেল, মেয়ে দু’টোকে কিচ্ছু কিনে দিতে পারিনি। হাত সাজানোর মেহেদী কেনার জন্য বায়না ধরেছিল ছোট মেয়ে, তবুও দেয়নি। বলেছি- আম বিক্রি করে মার্কেট (কেনাকাটা) করে দিবো। বউ তো কিছু চাই-ই না। তবুও আমে ভালো দাম পেলে নতুন কাপড়-চোপড়, আর খাওয়া-দাওয়া জুটবে। না হলে শ্যাষ!’

ঈদ শেষে আমের বাজার ভালো হলে আরেক ‘ঈদ’ আসবে -এমন প্রত্যাশা শুধু ইয়াকুব আলীর নয়, রাজশাহীর আমচাষিদের চোখে-মুখে ঠিক এমন প্রতিচ্ছবি চোখে পড়বে যে কারও। শুক্রবার (০৭ জুন) বিকেলে এবং শনিবার (০৮ জুন) সকালে জেলার পুঠিয়া, বানেশ্বর, চারঘাট, বাঘা, মোহনপুর, গোদাগাড়ী, তানোরে ঘুরে দেখা গেছে ঈদ শেষে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের আম নামানো কাজের তোড়জোড়। বাগানে আম নামিয়ে তা ক্যারেটে করে বাজারজাতকরণের কাজ শেষ করা হচ্ছে বাগানে বসেই।

চাষিরা এখন খিরসাপাত আম দ্রুত বাজারজাত করতে চাইছেন। পাক ধরে যাওয়ায় বাগানের গাছে ৪/৫ দিনের বেশি খিরসাপাত আম রাখা কষ্টসাধ্য বলছেন তারা। আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোপালভোগ শেষের পথে। বাগানে বেশি আম খিরসা। গাছে ধরেও বেশি এই জাতের আম। একটু পাকলেই পড়ে যায়। কোনোভাবে যদি এখন ঝড় হয়, তবে আম পড়ে সব নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও মাথায় রাখতে হচ্ছে চাষিদের।

মোহনপুরের বকশিমইল গ্রামের আজিবর মিয়া বলেন, ‘ঈদের কারণে বাজার ভালো ছিল না খিরসার। এখন দাম বাড়বে। মণপ্রতি ২০০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা বিক্রি হতে পারে। খিরসা নামানোর পর ল্যাংড়ায় হাত দেবো। তবে অনেকে এখন দাম বেশি পাওয়ার আশায় ল্যাংড়াও পাড়া শুরু করছে। আমার মনে হয়- ল্যাংড়াটা আরও ৪/৫ দিন পর নামালে বেশি ভালো হবে।’

চারঘাটের মোক্তারপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খিরসাপাত আম ঈদের আগে পাড়া দরকার ছিল। ঈদের পর আজ শনিবার (০৮ জুন) সকালে বাগানে গিয়ে দেখি- ব্যাপক আকারে পাকা আম পড়ে রয়েছে। গাছেও পেকে গেছে। এই আম পেড়ে বাজারে নিতে নিতে বেশি পেকে যাবে। যা কেউ কিনতে চাই না। রাজশাহীর আম দূর-দূরান্তে যায়। তাই সবাই কাঁচা আমের দিকে বেশি ঝোঁকে। মনে হচ্ছে- লোকসান গুণতে হবে।’

এদিকে, শনিবার সকালে রাজশাহীর সবচেয়ে বড় হাট বানেশ্বর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, হাটে আসা আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা সবাই প্রায় খিরসাপাত আম নিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ গোপালভোগ এবং কিছু ল্যাংড়া এনেছেন। সঙ্গে লক্ষ্মণভোগ আমও দেখা গেছে। গোপালভোগ শেষ দিকে হওয়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে।

বানেশ্বর বাজারে গোপালভোগ বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা মণ। খিরসা ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা মণ। আর অল্প পরিমাণে বাজারে আসা ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ থেকে ৩২০০ টাকা মণ। তবে ঈদ ফুরোলেও এখনো সেভাবে জমে ওঠেনি আমের বাজার।

জানা যায, গত ১২ মে চলতি মৌসুমের আমপাড়ার সময়সীমা বেঁধে দেয় জেলা প্রশাসন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- গত ১৫ মে থেকে দেশি জাতের গুঁটি আম পাড়া শুরু হয়। ২০ মে থেকে গোপালভোগ, ২৮ মে খিরসাপাত, ৬ জুন ল্যাংড়া আম গাছ থেকে পাড়া শুরু করে চাষিরা। আর ১৬ জুন আম্রপালি, ফজলি ও সুরমা ফজলি এবং ১ জুলাই আশ্বিনা আম পাড়া যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছর রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধু বাঘা উপজেলাতে ৮ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আমচাষ করা হয়েছে।


শর্টলিংকঃ