ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বিখ্যাত শিষ্যরা


তিনি কেবল পিতার জৈবিক উত্তরাধিকারী ছিলেন না। সংগীতের উত্তরাধিকারীও ছিলেন। পিতা উপমহাদেশের কিংবদন্তি সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। গুরু তো বটেই। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বিখ্যাত শিষ্যদের অন্যতম তারই ঔরসজাত পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। মানসপুত্র বললেও কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। পিতা পুত্রকে বিশেষভাবে সরোদের তালিম দিয়েছিলেন। সরোদ যেন তার হাতে কথা বলত। আলী আকবর খাঁর সরোদ বাজানো শুনে যোধপুরের মহারাজা হনবন্ত সিং তাকে ‘ওস্তাদ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে এলাহাবাদের এক সংগীত সম্মেলনে রবিশঙ্করের সঙ্গে একত্রে বাজিয়েছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। রবিশঙ্কর তখনো পণ্ডিত হননি। হওয়ার পথে ছিলেন। পণ্ডিত হয়ে ওঠার সে যাত্রায় তাকে দিশা দেখাচ্ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাই কেবল ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর সহবাদক নন, ছিলেন গুরুভাইও। একই গুরুর শিষ্য—সতীর্থ। গুরুর কাছ থেকে তিনি সেতারের তালিম নিয়েছিলেন। সেতার বাজিয়েই পেয়েছেন জগৎজোড়া খ্যাতি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। অনেকটা বর্তমানের সুপারস্টারসুলভ খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি।

ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর যুগলবন্দি হয়ে অনেক জায়গায় বাজিয়েছিলেন। সরোদে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, সেতারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর। জাদুকরী সুরের মূর্ছনায় শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতেন তারা। তবে বাংলাদেশের মানুষ এ দুই সংগীত মায়েস্ত্রোকে বিশেষভাবে মনে রাখবে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর জন্য। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ওস্তাদ ও পণ্ডিত পরিবেশন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ ধুন’। সম্পূর্ণ নতুন এক সুর। সরোদ ও সেতারের যুগপৎ তানে শ্রোতাদের কানে কানে ধ্বনিত হয়েছিল এক অভূতপূর্ব সংগীতের অনুরণন।

ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের মধ্যে সম্পর্ক এখানেই শেষ নয়। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর বোনকে বিয়ে করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এখানেই চলে আসে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আরেক শিষ্যের নাম। অন্নপূর্ণা দেবী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা। ওস্তাদ আলী আকবর খানের বোন এবং পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথম স্ত্রী। খ্যাতির বিবেচনায় ভাই ও প্রথম স্বামীর তুলনায় অনেকটাই নিষ্প্রভ হলেও বিদ্যার দিক দিয়ে কোনো অংশেই কম ছিলেন না। স্বয়ং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাকে ‘মূর্তিমতী মা সরস্বতী’ বলে ডাকতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তার এ আত্মজাকে সুরবাহারের তালিম দিয়েছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিত হিসেবে অন্নপূর্ণা দেবীর তুলনা খুব কমই আছে।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছাড়াও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর হাতে গড়া আরেক শিষ্য সেতারে পাণ্ডিত্য অর্জন করে খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি পণ্ডিত নিখিল রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। মাইহার ঘরানার একজন ধ্রুপদি সেতারবাদক। অথচ আলাউদ্দিন খাঁ প্রথমে তাকে শিষ্য হিসেবে বরণ করতে চাননি। পরে রেডিওতে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সম্প্রচার শুনে তিনি তাকে সেতারে তালিম দিয়েছিলেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে সেতারের বিভিন্ন শৈলীর বিকাশ ঘটিয়েছেন তিনি।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আরেক বিখ্যাত শিষ্য পান্নালাল ঘোষ। তিনি অমলজ্যোতি ঘোষ নামেও পরিচিত। তিনি বাঁশি বাজিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে বাঁশিকে আবশ্যকীয় করে তোলার কৃতিত্ব তাকেই দেয়া হয়। বলা হয়, তিনিই প্রথম সাত গর্তের বাঁশি প্রচলিত করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরিবারের সদস্য, একই সঙ্গে তার শিষ্য হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন তারই ভ্রাতুষ্পুত্র ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান ও নাতি ওস্তাদ আশীষ খান দেবশর্মা। ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান একজন সর্বভারতীয় বিখ্যাত সরোদবাদক। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণ রেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সহ ঋত্বিক ঘটকের বিখ্যাত সব ছবিতে তিনি সংগীত পরিচালক ছিলেন। ওস্তাদ আশীষ খান দেবশর্মাও স্বনামধন্য সরোদবাদক। তিনি তার ‘গোল্ডেন স্ট্রিংস অব সরোদ’ অ্যালবামের জন্য ২০০৬ সালে গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নিছক ব্যক্তি নন, ছিলেন সংগীতের একটি প্রতিষ্ঠান। তার অগণিত শিষ্য সংগীত সাধনায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো মাত্র।

আহমদ শাকিল: লেখক


শর্টলিংকঃ