করোনায় গভীর সংকটে বিমান চলাচল খাত


ইউএনভি ডেস্ক

করোনাভাইরাসের কারণে গভীর সংকটে পড়েছে দেশের বিমান চলাচল খাত। শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে একের পর এক বিমানবন্দর। বাতিল এবং কাটছাঁট করা হচ্ছে এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র নেপালসহ অসংখ্য দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশ বিমানও বিশ্বের ১০টি রুটে ১৪২টি ফ্লাইটের মধ্যে ৮০টির বেশি ফ্লাইট বাতিল করেছে।

করোনায় গভীর সংকটে বিমান চলাচল খাত

এছাড়া সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য রিয়াদ, দাম্মাম, জেদ্দা ও মদিনায় বিমানের ফ্লাইট বন্ধ থাকবে।পাশাপাশি বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা, নভো ও রিজেন্ট এয়ারও তাদের ফ্লাইট শিডিউল কাটছাঁট করে অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। বিশ্বজুড়ে নামিদামি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটেও চলছে বড় ধরনের কাটছাঁট। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বড় ধাক্কা খেয়েছে নরওয়েজিয়ান এয়ার।

ইতিমধ্যে এয়ারলাইন্সটি ৪ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল করেছে। অর্ধেকের বেশি বিমানকর্মীকে কাজে না আসার নির্দেশ দিয়েছে বিমান সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালে যাত্রী সংখ্যা কমে আগের তুলনায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।

এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে ২০১৮ সালে প্রতিদিন ৯ হাজার ৮৩৩ জন যাত্রী দেশে এসেছেন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১০ হাজার ১৬৬ জন। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই সংখ্যা কমতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় গড়ে প্রতিদিন ৭ হাজার।

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ ফেরত যাত্রী আরও কমে গেছে। গত সপ্তাহের হিসাব অনুযায়ী এখন প্রতিদিন গড়ে ২৪ ঘণ্টায় যাত্রী আসছেন আড়াই হাজারের মতো। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে প্রায় ২৮টি এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল-আহসান বলেন, শাহজালালে যাত্রী অনেকটাই কমে গেছে। বিশেষ করে বহির্গামী যাত্রী অর্ধেকের বেশি কমেছে।

বিমানবন্দরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে বিমানযাত্রী ছিলেন ২৭ লাখ ৬২ হাজার। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ২২ লাখ ৫৫ হাজার, আর অভ্যন্তরীণ রুটে ৫ লাখ ৭ হাজার। অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যাত্রী এসেছে ২ লাখ ৪৯ হাজার। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ১ লাখ ৯৫ হাজার, অভ্যন্তরীণ ৫৪ হাজার। ফেব্রুয়ারিতে মোট যাত্রী সংখ্যা ২ লাখ ১৮ হাজার। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ১ লাখ ৭৫ হাজার আর অভ্যন্তরীণ ৪৩ হাজার। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর মার্চে এই সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যাত্রীদের পাশাপাশি আয় কমে গেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের। করোনাভাইরাসের আগে প্রতিমাসে দেশের অ্যাভিয়েশন খাত থেকে রাজস্ব আসত ১২০ কোটি টাকা থেকে ১৫০ কোটি টাকার বেশি অর্থ। কিন্তু জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এই অঙ্ক ৮০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে।

অথচ বেবিচকের হিসাব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেবিচকের আয় ছিল ১০৯৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই আয় বেড়ে হয়েছিল ১৩১৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই আয় আরও বেড়ে হয়েছিল ১৩৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই আয় আরও বেড়ে ১৪৩৮ কোটি টাকা হয়। কিন্তু দুই মাস ধরে গড়ে আয় হচ্ছে মাসে ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকা।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশ থেকে যাত্রী আসা কমে গেছে। কিন্তু দেশ ছাড়ছেন বেশি। তবে বিভিন্ন দেশ ফ্লাইট বাতিল করায় এখন বাংলাদেশ থেকেও বিদেশগামী যাত্রী কমছে।

এই পরিস্থিতিকে দেশের এভিয়েশন শিল্পের জন্য ‘মহাবিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করলেন এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) সাধারণ সম্পাদক ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের এভিয়েশন শিল্পে করোনাভাইরাস শুধু বিপর্যয় নয়, ‘মহাবিপর্যয়’ ডেকে এনেছে। এই অবস্থায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে। এওএবির পক্ষ থেকে আমরা সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা চেয়ে শিগগিরই চিঠি দেব।

আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট ৬০ শতাংশের বেশি কমে গেছে উল্লেখ করে ইউএস-বাংলার সিইও ক্যাপ্টেন সিকদার মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি এখন বড় ঝুঁকির মুখে পড়েছে। শুধু উড়োজাহাজের কিস্তি পরিশোধ নয়, সিভিল এভিয়েশনের চার্জ, কর্মীদের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়সহ নানা ব্যয় টানতে গিয়ে আমরা ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছি।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘কাতার-কুয়েত-সৌদি ও নেপাল বাংলাদেশি যাত্রীদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় সব ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করেছে বিমান। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস ২৭০ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে।

ফ্লাইট কাটছাঁট এবং ওমরা না করতে পারায় বিমানকে এই ক্ষতি গুনতে হবে। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, এই ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, বিমানের পাশাপাশি ক্ষতি গুনছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও।

করোনা আতঙ্কে যাত্রীর সংকট আর বিভিন্ন দেশে বিমান যোগাযোগ বন্ধের কারণে এভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে বিমান পরিবহন সংস্থা ও রেগুলেটরি কমিশন। বড় বড় বিমানবন্দর দিন দিন ফাঁকা হয়ে পড়েছে। অনেক এয়ারলাইনস তাদের কর্মীদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক ছুটিতে পাঠিয়েছে। অনেক বিমান সংস্থার পাইলট এবং কর্মীরা ভাইরাসে আক্রান্তের ভয়ে কাজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে দেশে দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ব পর্যটনে ধস নেমেছে।

বিশ্বজুড়ে গত দুই মাসে ২ লাখেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থা (আইসিএও) জানিয়েছে, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বিশ্বের বিমান সংস্থাগুলোকে ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত লোকসানের মাশুল গুনতে হতে পারে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে বিমান চলাচল ৩৫ শতাংশ কমে এসেছে। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা আইএটিএ এটিকে গত এক দশকে ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, মূলত করোনাভাইরাসের কারণে যাত্রীদের ভ্রমণ অনীহা এবং ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিমান চলাচল বন্ধ করেছে বিভিন্ন দেশ। ফ্লাইটগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে কম যাত্রী হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।

উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিমান চলাচলের ট্র্যাককারী এনওয়াইএসই আরকা এয়ারলাইনস ইনডেক্স থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে রাজস্ব আয় ৪০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। গত এক দশকে প্রথম এ ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ল বিমান চলাচল শিল্প।

বিমান সংস্থাগুলোর জোট ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) আশঙ্কা করছেন, এভাবে অব্যাহত থাকলে বিশ্বের বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোকে ১১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। দেশের সব এয়ারলাইনসের মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্য।

প্রবাসী শ্রমিক ও হজকেন্দ্রিক যাতায়াতকে কেন্দ্র করে এই রুট সবচেয়ে লাভজনক গন্তব্য। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার, সৌদি আরব ও কুয়েত করোনাভাইরাসের কারণে বিমান চলাচল স্থগিত রাখায় এই রুটে ফ্লাইট কমেছে, কেউ কেউ বন্ধও করেছে। এছাড়া এশিয়ার পর্যটনকেন্দ্রিক গন্তব্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপেও করোনাভাইরাসের কারণে ফ্লাইট কমেছে।

করোনাভাইরাসের কেন্দ্রস্থল চীনের সঙ্গে বিমান চলাচল কার্যত বন্ধ। এই রুটে ফ্লাইট অনেকটা শূন্যের কোঠায় নেমেছে। সর্বশেষ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কয়েকটি বিশেষ ক্যাটাগরির বাইরে বিশ্বের সব দেশের নাগরিকদের ভিসা স্থগিত করেছে ভারত ও নেপাল সরকার। এ কারণে দেশটিতে বিমান চলাচল স্থগিত করেছে বিমান বাংলাদেশ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ।


শর্টলিংকঃ