কর্ণফুলীর রহস্যময় পাথর এবং পীর বদরের কিংবদন্তি


কিছুদিন আগে ১৭৬৪ সালে আঁকা চট্টগ্রাম শহরের একটি দুর্লভ মানচিত্র হাতে আসে। সেই মানচিত্রের সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্যটি হলো কর্ণফুলী নদীর আকৃতি ও গতিপথ। ইতিহাসে আছে একসময় কর্ণফুলী নদী শহরের অনেকখানি ভেতরের দিকে বয়ে যেত। কিন্তু এ মানচিত্র দেখার আগে সেই বিষয়ে চাক্ষুষ কোনো প্রমাণ ছিল না। এখানে দেখা যাচ্ছে কর্ণফুলী নদী আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের একদম কোলঘেঁষে প্রায় সোজাসুজি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এখনকার মতো ইংরেজি S অক্ষরের মতো দুই বাঁক নিয়ে পশ্চিমমুখী হয়ে মোহনায় যেত না। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা বর্তমানের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি ছিল।

বার্থোলোমিউ প্লেইস্টেডের আঁকা সেই মানচিত্রে শহরের খুব বেশি জায়গা দেখানো হয়নি। সব মিলিয়ে মোটামুটি ৩০টির মতো স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই ৩০টি চিহ্নিত স্থাপনার মধ্যে কর্ণফুলী নদীতে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা গেছে। বর্তমান আসাদগঞ্জের দক্ষিণে নদীর মধ্যে দুটো পাথরকে চিহ্নিত করা হয়েছে the two rocks নামে। অনুমান করা যায় পাথর দুটো বিশাল আকৃতির ছিল এবং নদীর মধ্যে থাকা একমাত্র ল্যান্ডমার্ক। এ পাথর দুটো বিশেষভাবে চিহ্নিত করার অর্থ কী? সাধারণ পাথর হলে সেটা মানচিত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কথা নয়। প্রায় ২৬০ বছর আগের মানচিত্রে দৃশ্যমান সেই পাথর দুটো নিয়ে কোনো তথ্যেরও সন্ধান মেলেনি কোথাও। এ সম্পর্কে কারো কোনো ভাষ্য থাকলেও সেটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু পাথরগুলো দেখে আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে থাকা পাথরের সঙ্গে অতীতের কোনো কিংবদন্তির সম্পর্ক আছে কি?

প্রশ্নটা যে কারণে উঠেছে তা হলো যেই এলাকায় পাথর দুটো দেখানো হয়েছে সেই এলাকায় সুলতানি আমলের একটি প্রাচীন সমাধি আছে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত পীর বদর আউলিয়ার সমাধি। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে তিনি ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমলে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তাকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি চালু আছে। যার একটি হলো তিনি চেরাগের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ভূতপ্রেত তাড়িয়ে মানুষের বসবাসের উপযোগী করেছিলেন। অন্যটি হলো তিনি পাথরের নৌকায় চড়ে এ শহরে এসেছিলেন। মানচিত্রের পাথর দুটো দেখে আমার সেই কিংবদন্তির কথা মনে পড়ল। পাথরে তৈরি নৌকা ভেসে থাকতে পারে না জেনেও অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী মানুষ যুগ যুগ ধরে ওই কিংবদন্তি বহন করে এসেছে। কিন্তু পাথর দুটোর সঙ্গে সেই কিংবদন্তির আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, এখন আর সেটা বলা সম্ভব নয়। অতএব কিংবদন্তির কথা বাদ দিয়ে ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক।

চট্টগ্রাম শহরে সুলতানি আমলের যেসব স্থাপনা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে সম্ভবত বদরপাতি এলাকায় অবস্থিত বদরউদ্দিন আউলিয়ার মাজারটি একমাত্র স্থাপনা যেটি এখনো টিকে আছে। বদর আউলিয়া চট্টগ্রামে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের কাজে। তিনি ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সঙ্গে এসেছিলেন নাকি পরবর্তীকালে এসেছিলেন সেটা নিয়ে ১ বিতর্ক আছে। তার আগমনের সঙ্গে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের চট্টগ্রাম দখলের কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা সেটা বোঝার জন্য একটু পেছনে যেতে হবে।

দিল্লির সিংহাসনে যখন তুঘলক বংশের শাসক মোহাম্মদ শাহ, বাংলায় তখন তার অধীন গভর্নর বাহরাম খান। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ছিলেন বাহরাম খানের সিলাহদার বা অস্ত্রাগারপ্রধান। বলা চলে তিনিই বাহরাম খানের ডান হাত। ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিকভাবে বাহরাম খানের মৃত্যু হলে গভর্নরের পদটা খালি হয়ে পড়ে। এ দেশের ইতিহাসে সিংহাসন শূন্য হলে প্রথমে সেটা কাছের মানুষেরাই কবজা করার সুযোগ গ্রহণ করে। ফখরুদ্দিনও তার ব্যতিক্রম করেননি। দূরবর্তী ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লির নির্দেশ আসার আগেই ফখরুদ্দিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন সোনারগাঁও কেল্লা দখল করার। কিন্তু তিনি শুধু গভর্নর হিসেবে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে।

বাংলা দখল করেই ফখরুদ্দিন বসে থাকেননি। নজর দিয়েছিলেন প্রতিবেশী রাজ্যের দিকেও। পশ্চিমের লখনৌতি এবং সাতগাঁও আক্রমণ করে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পূর্বদিকের রাজ্য ত্রিপুরা। ত্রিপুরার প্রতাপ মাণিক্যকে পরাজিত করে তিনি নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চল অধিকার করেন। তারপর চাটগাঁ অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

চাটগাঁ তখন ত্রিপুরার সামন্ত শাসকের অধীন একটি প্রদেশ। একটি সূত্রমতে সেই সময়ে আরব দেশ থেকে আগত কয়েকজন সুফি সাধক চাটগাঁয় এসেছিলেন। সেই সাধকরা ধর্ম প্রচারের কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বদর পীর এবং কদল শাহ গাজি। তারা ফখরুদ্দিনের কাছে সাহায্য কামনা করেছিলেন। ফখরুদ্দিন তাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসে চট্টগ্রাম আক্রমণ করেছিলেন।

আরেকটি সূত্র বলছে, পীর বদর এবং কদল শাহ গাজি তার সঙ্গী-সাথী অন্যান্য দরবেশ ও ফকিরদের নিয়ে ফখরুদ্দিনের অভিযানে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছিলেন। ফখরুদ্দিনের বাহিনী সম্ভবত নৌপথে চাটগাঁ আক্রমণ করেছিল। আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল আন্দরকিল্লার প্রাচীন দুর্গ অধিকার করা। তিনি সেই দুর্গ অধিকার করার পর কর্ণফুলীর অন্য পারে আরো একটি দুর্গ দখল করেন। সেই দুর্গটি দেয়াঙ অঞ্চলে অবস্থিত। দেয়াঙ এলাকা কয়েক শতাব্দী আগে হরিকেল রাজ্যের রাজধানী কিংবা প্রধান নগরী ছিল। তখনই সম্ভবত দুর্গটি তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সেটি আরাকানিদের অধিকারে চলে গিয়েছিল। পর্তুগিজদের দেয়াঙ অধিকারের পর যে দুর্গটি তৈরি হয় সেটাই ওই দুর্গ কিনা নিশ্চিত বলা যায় না। সেই যাই হোক, ফখরুদ্দিনের চাটগাঁ জয়ের পর পুরো এলাকা একটি প্রদেশ হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চাটগাঁ বিজয়ের এ ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে সত্য হলেও ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের শাসনকালের বিস্তারিত কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এমনকি তার অভিযানের সময়কাল নিয়ে প্রধান সূত্রটি নেয়া হয়েছে বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যখন বঙ্গদেশে আসেন তখন তিনি প্রথমে চাটগাঁয় পা রেখেছিলেন। তিনি চাটগাঁকে ‘সোদকাওয়ান’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন সেখানকার শাসক ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। এতে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় চাটগাঁ বিজয়ের ঘটনাটি ১৩৩৮ থেকে ১৩৪৬ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে ঘটেছিল।

দ্বিতীয় সূত্রটি পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীর কবি মোহাম্মদ খানের কাছ থেকে। ড. আবদুল করিম সেই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—

সপ্তদশ শতকের কবি মোহাম্মদ খান, তাঁহার বংশ পরিচয় দেওয়ার সময় অলক্ষ্যে মুসলমানদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী এবং বিশেষ করিয়া চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের কাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন। কবি বলিয়াছেন যে, কদল খান গাজী পীর ‘অসংখ্য রিপুদল’ পরাজিত করিয়া চট্টগ্রামে এক আল্লার মহিমা প্রকাশ করেন, অর্থাৎ ইসলাম প্রচার করেন। কদল খান গাজী পীরের সঙ্গে তাঁহার একাদশ মিত্র ছিল। জনশ্রুতি মতে চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ, অর্থাৎ বার জন আউলিয়া সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে আসিয়া ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কবি মোহাম্মদ খানের সাক্ষ্য এই জনশ্রুতির ঐতিহাসিকতা স্বীকার করিতে সাহায্য করে যদিও কবি তাঁর পুস্তকে বারোজন আউলিয়ার নাম উল্লেখ করেন নাই। শুধু মাতৃকুল পরিচয় দিতে গিয়া কবি তাহার পূর্বপুরুষ শয়খ শরীফ-উদ-দীনের নাম উল্লেখ করিয়াছেন, যিনি কদল খান গাজীর ‘প্রেমের সখা’ ছিলেন, অর্থাৎ বার আউলিয়ার অন্যতম ছিলেন। পরে পিতৃকুল পরিচয় দেওয়ার সময় কবি বার আউলিয়ার আর একজন পীর বদর আলমের নাম বলিয়াছেন। কবি বলিয়াছেন যে তাঁহার পূর্বপুরুষ মাহি আসোয়ার তাঁর সঙ্গী হাজী খলিল পীরসহ আরব দেশ হইতে চট্টগ্রামে আসিয়া পৌঁছিলে কদল খান গাজী, বদর আলম এবং অন্যান্য আউলিয়ার সাথে তাহাদের সাক্ষাৎ হয়।

তৃতীয় সূত্রটি দিয়েছেন সপ্তদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশ। তিনি বলেছেন,

‌সুদূর অতীতে ফখর-উদ-দীন নামে বাংলার একজন সুলতান চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে জয় করেন এবং শ্রীপুরের উল্টাদিকের নদীর অপর তীরে অবস্থিত চাঁদপুর হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ তৈয়ার করেন। চট্টগ্রামে যেই সকল মসজিদ ও সমাধি ভবন রহিয়াছে, সেইগুলি ফখর-উদ-দীনের সময়ে নির্মিত, ধ্বংসাবশেষ হইতে ইহার প্রমাণ হয়।

বদর আউলিয়া সম্পর্কে এ অঞ্চলের সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে একটা গভীর শ্রদ্ধা ও সমীহ কাজ করত। চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষক শামসুল হোসাইন লিখেছেন,

‍বদর আউলিয়া আরো এগারোজন দরবেশের সঙ্গে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। এ দরবেশগণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সমাহিত আছেন। বারোজন দরবেশের মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। বদর আউলিয়া চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন। এ কারণে লোকপ্রিয়ভাবে চট্টগ্রাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। চট্টগ্রাম জেলার মানব বসতির সাথে বদর আউলিয়ার নাম জড়িত। চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তাঁকে তাদের অভিভাবক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা করে। বৌদ্ধ, হিন্দু ও চৈনিকগণ বদর আউলিয়াকে পরমেশ্বর অথবা আত্মার অধস্তন হিসেবে ভক্তি করে। অন্যদিকে মুসলিমগণ তাঁকে আউলিয়া বা দরবেশ হিসেবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। পূর্ব বাংলার মাঝিরা অন্য পাঁচজন দরবেশের (যারা পাঁচ পীর নামে পরিচিত) সাথে বদর আউলিয়ার নাম উচ্চারণ করে থাকে। সমুদ্র উপকূল ধরে দক্ষিণে সুদূর মালয় উপদ্বীপ ছাড়িয়েও সমুদ্রগামীদের কাছে তিনি নিত্যদিনের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত। আরাকানের মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ রাজাগণ তাঁর সমাধির জন্য কয়েকটি গ্রাম ওয়াকফ করে দেন এবং তারা তীর্থযাত্রী হিসেবে এ পবিত্র মাজারে আসতেন ও মাজারে দান করতেন। মায়ানমারের টেনাসেরিমের জনগণ তাঁকে মাদরা বলে ডাকত। আকিয়াবের অধিবাসীদের কাছে তিনি বুদ্ধ আউলিয়া বা বুদ্ধ সাহেব হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকে যেমন বদর আলম, বদর আউলিয়া, বদর পীর বা পীর বদর ও বদর শাহ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে তাঁর নাম ‘শাহ বদর আলম’ হিসেবে পাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম যখন আরাকানের শাসনে ছিল তখন আরাকানি শাসকরাও এ মাজারকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। আরাকানিরা এখানে এসে তাদের ভক্তি নিবেদন করত। তখনকার আরাকানি শাসক এ মাজারের ব্যয়ভার বহনের জন্য কয়েকটা গ্রাম ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন—

‘On a height within the fort is a tomb, known as astana of Pir Badar; the attendants of the shrine perform prayer and fast. The Magh infidels…..have settled some villages in wakqf on this tomb; they make pilgrimage to the holy dead and offer presents.’

পরবর্তী যুগে বার্মার শাসকরাও সমাধিটাকে বিশেষ সম্মান করত বলে জানা গেছে। ১৭৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে চট্টগ্রামে গভর্নরকে লিখিত চিঠিতে বার্মার রাজা হজরত বদরুদ্দিনকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাধক হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির পূর্বদিকে জেলখানার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেটা ধরে কিছুদূর গেলেই হাতের বাম দিকের একটা গলিপথের ভেতর এ মাজারের অবস্থান। চারদিকে দেয়ালঘেরা মাজার কমপ্লেক্সের পূর্ব দিকে একটা প্রবেশপথ আছে। ভেতরে ঢুকলে একটা পাকা কুয়া দেখা যায়। মাজারের পশ্চিম দিকে একটা বেলে পাথরের শিলালিপি রয়েছে। শিলালিপিতে আনুভূমিকভাবে নাসখ রীতিতে পাঁচ লাইনে আরবি লিপি উৎকীর্ণ। লিপিটি সম্ভবত প্রাচীনকাল থেকে এভাবেই আছে। আদি যুগ থেকে চট্টগ্রামের সওদাগররা বাণিজ্য করার জন্য সমুদ্রযাত্রায় বের হওয়ার সময় এ মাজারে এসে দোয়া নিতেন। প্রায় ৭০০ বছর আগে মাজারটি যখন কর্ণফুলী নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে ছিল তখন নদীর দিকে একটি এবং নদীর বিপরীত দিকে আরেকটি গেট ছিল। এখন রাস্তার মুখোমুখি গেটটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু পেছনের গেটের ধ্বংসাবশেষ আছে। বদর আউলিয়ার রীতি মেনে বারোজন আউলিয়ার সম্মানে এখনো প্রতি রাতে ১২টি চেরাগ জ্বালানো হয় এই সমাধিতে।

কিন্তু কর্ণফুলী নদীর সেই পাথর দুটো কোথায় গেল? অত বিশাল দুটো পাথর হাওয়া হয়ে যেতে পারে না। পাথর দুটো যেখানে ছিল, নদী ভরাট হয়ে আরো মাইলখানেক দক্ষিণে চলে গেছে। সেই হিসেবে পাথরঘাটা ব্রিকফিল্ড রোডের আশপাশে কোথাও সেই পাথর দুটোর অবস্থান হওয়ার কথা। হয়তো পাথরগুলো ভেঙে তার ওপর দালানকোঠা গড়ে তোলা হয়েছে। ঐতিহাসিকরা বলেন, বদর পীর পাথরের নৌকায় ভেসে এসেছিলেন বলে ওই এলাকার নাম পাথরঘাটা। আমার ধারণা, সেই পাথর দুটোর কারণেই ওই এলাকার নাম হয়েছিল পাথরঘাটা। পাথরগুলো হারিয়ে গেছে, কিন্তু কিংবদন্তি বেঁচে আছে এখনো।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলার ইতিহাস-সুলতানী আমল, ড. আবদুল করিম

২. বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর: স্বাধীন সুলতানদের আমল (১৩৩৮-১৫৩৮), সুখময় মুখোপাধ্যায়

৩. The History of Bengal : From the First Mohammedan Invasion Until the Virtual Conquest of that Country by the English, A.D. 1757, Charles Stewart

৪. বদর আউলিয়া (বাংলাপিডিয়া নিবন্ধ)-শামসুল হোসাইন

৫. A History of Chittagong, Volume 1. : Suniti Bhushan Qanungo

৬. অতীত চিত্রে চট্টগ্রাম, শেখ শওকত কামাল

৭. Studies in Mughal India, Jadunath Sarkar, Longmans Green and Co. New York (1920)

৮. চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন ইমারত, আহমেদ মুনির: প্রথম আলো ২২ আগস্ট ২০১৩

হারুন রশীদ: প্রাচীন সভ্যতা ও ইতিহাস অনুসন্ধানী লেখক


শর্টলিংকঃ