ক্যান্সারের রোগী বাড়ে, চিকিৎসা বহুদূর


ইউএনভি ডেস্ক:

হাসপাতালের তৃতীয় তলায় বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন। সেখান থেকে টিকিট সংগ্রহের পর এই কয়েকশ’ মানুষকে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়ার জন্য আবারও দাঁড়াতে হবে দীর্ঘ লাইনে। একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি নিয়ে কেউ হাসপাতালের ফ্লোরেই বসে পড়েছেন। কেউবা মাদুর পেতে শুয়ে পড়েছেন। ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনের চোখে-মুখেও বিষাদের ছায়া। অনেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, আবার কেউ কান্নাকাটিও করছেন।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

এ চিত্র রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের। এমন প্রেক্ষাপটে আজ মঙ্গলবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। ক্যান্সারে অকালমৃত্যুর সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আমি আছি এবং আমি থাকব’।

গত রোববার সরেজমিনে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ঘুরে এবং রোগী ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ক্যান্সার চিকিৎসার নানা করুণ কাহিনি। বরিশালের পিরোজপুর এলাকার শাহিন তার বাবা আজম আলীকে নিয়ে কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ক্যান্সার শনাক্ত হয় তার। সবশেষে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেফার করা হয় তাকে। এখানে প্রায় এক মাস ধরে ঘোরাঘুরি করলেও পারছেন না তার বাবাকে ভর্তি করাতে।

এমন অভিযোগ উপস্থিত আরও ১০ রোগীর স্বজনের। তাদের ভাষ্য, কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতেই তার দুই দিন কেটে যায়। ওই চিকিৎসক যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছিলেন তা সম্পন্ন করতে আরও এক সপ্তাহ লেগে যায়। রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক ভর্তির পরামর্শের জন্য বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডে রেফার করেন। তিন দিন অপেক্ষার পর মেডিকেল বোর্ড তার বাবাকে ভর্তির সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু শয্যা ফাঁকা নেই। ফাঁকা শয্যার জন্য প্রতিদিনই খোঁজখবর নিতে তাকে হাসপাতালে আসতে হয়। শয্যা ফাঁকা হলেও তার দেখা মেলে না। কারণ, উচ্চ পর্যায়ের তদবিরে তা অন্য কেউ পেয়ে যান কিংবা এক শ্রেণির দালাল অর্থের বিনিময়ে শয্যা পাইয়ে দেয় অন্য কাউকে। এই দুই কারণে এখানে চিকিৎসা সুবিধা মিলছে না দরিদ্র মানুষের। মাসের পর মাস ঘুরেও আক্রান্ত রোগীরা ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। ৩০০ শয্যার এ হাসপাতালে রোগী ভর্তির চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

এ বিষয়ে সম্প্রতি হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী মোশতাক হোসেন জানান, কয়েকদিন আগে তিনি এখানে যোগ দিয়েছেন। রোগীকে আরও বেশি সেবার সুযোগ তৈরির জন্য কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তারা। তবে দীর্ঘদিনের সমস্যা চাইলেও কেউ রাতারাতি সমাধান করতে পারবেন না।

ডা. মোশতাক হোসেন জানান, ক্যান্সার রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ১০০ শয্যার নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এ প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। এটি সম্পন্ন হলে ক্যান্সার সেবার পরিধি আরও বাড়বে। চিকিৎসাও মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছবে।

চিকিৎসার আওতায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ :

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেহের প্রধান পাঁচটি অঙ্গ ফুসফুস, স্তন, জরায়ু, খাদ্যনালি ও পাকস্থলি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৫ লাখ মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত। অপরদিকে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর ক্যান্সার (আইএআরসি) বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে এক লাখ আট হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় শয্যা আছে মাত্র ৫০০। অর্থাৎ একটি শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা তিন হাজার। আক্রান্তের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। অন্যরা চিকিৎসা সেবার বাইরে থাকছে।

তবে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে। রোগীর উপচেপড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপির জন্যও পড়তে হয় দীর্ঘ সিরিয়ালে। তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হয় সেবা পেতে। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না থাকায় দেশের সব জেলার রোগীরা এই হাসপাতালেই ভিড় করেন। ক্যান্সার হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে এই সুযোগে চিকিৎসা-বাণিজ্য করছেন। অধিকাংশ চিকিৎসকই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে ক্লিনিক খুলে বসেছেন। অতিরিক্ত অর্থ আদায়েরও অভিযোগ আছে এসব ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন।

চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়েও অবহেলা :

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যাপক ডা. মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক পদ থেকে অবসরে গেছেন। চার বছরের বেশি সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ছিলেন। মেয়াদের একেবারে শেষ দিকে এসে তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। যন্ত্রপাতি কেনাকাটার অনিয়ম-দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন সদ্য সাবেক পরিচালক। প্রায় এক যুগ আগে আইসিইউ ইউনিটের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি বার বার প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করা হলেও তিনি তা করেননি। সর্বশেষ গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর আইসিইউ ইনচার্জ লিখিতভাবে পরিচালককে যন্ত্রপাতি বসানোর জন্য চিঠি দেন। তাতেও সাড়া দেননি পরিচালক। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকায় যন্ত্রপাতির কিছু অংশ চুরি হয়েছে। আবার কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। উচ্চ আদালত সাবেক পরিচালকের অবসরকালীন সুবিধা স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য চাইলেও ডা. মোশাররফ কোনো মন্তব্য করেননি।

সঠিক পরিসংখ্যান নেই, নিবন্ধন কার্যক্রমও বন্ধ :

আইএআরসি’র সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ তা ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তবে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সঠিক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেই- এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপও হয়নি। ২০০৫ সালে দেশে হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হলেও তা অজ্ঞাত কারণে থমকে যায়। ২০০৯ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। এজন্য জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলও গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে এ কাউন্সিলের উপদেষ্টা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সভাপতি, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদাধিকার বলে এই কাউন্সিলের সম্পাদক। কর্মসূচি প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল গঠনের মধ্যেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। তিনি বলেন, ২০০৫ সালে তার নেতৃত্বে জরিপ কাজ শুরু হয়েছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সব হাসপাতালে চিঠি পাঠিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা জানাতে বলা হয়েছিল। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সরবরাহও করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. রাসকিন।

ক্যান্সার রোগীদের জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ডা. রাসকিন বলেন, আক্রান্তের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলে সেবার পরিসর নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশে এখন ক্যান্সারের চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি প্রতিরোধ কর্মসূচি। কী করলে, কীভাবে জীবনযাপন করলে মানুষের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে, সে সম্পর্কে কোনো কর্মসূচি নেই। এ খাতে বরাদ্দও নেই। অথচ এগুলো বেশি বেশি করে প্রচার করলে সচেতনতা বাড়বে। এতে করে আক্রান্তের সংখ্যাও কমবে বলে মনে করেন তিনি। উৎস: সমকাল

আরও পড়তে পারেন ‘স্বপ্ন পুরণের জন্য সাধ্য অর্জন করতে হবে’: রাবি অধ্যাপক বসাক


শর্টলিংকঃ