এমপি হতেই মিলল দেড় কোটির গাড়ি


নিজস্ব প্রতিবেদক:

এমপি হয়েই বিতর্কিত এক ব্যবসায়ীর গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদের বিরুদ্ধে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পরদিন থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক চলাফেরা করছেন অন্তত দেড় কোটি টাকা দামের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়িতে (গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-৩৮৩৬)।

গাড়িটির মালিক মুখলেসুর রহমান মুকুল হুন্ডি তথা বিদেশে অর্থ পাচার চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিত। এমনকি এমপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি তিনি বালুমহাল ইজারাও পেয়েছেন।

অবশ্য এমপি হওয়ার পর আসাদ এক অনুষ্ঠানে অকপটে স্বীকারও করেছেন বিভিন্ন তদবির পূরণে তার কাছে কোটি কোটি টাকার অফার আসছে। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এই লোভ আমি কতটুকু সংবরণ করতে পারব জানি না। তবে আমি চেষ্টা করব। এখানে কোটি টাকার নিচে কোনো কথাই হয় না। এই করে দিতে হবে (তদবির পূরণ) আপনি আমার সঙ্গে এইখানে আসেন।’

এদিকে শুধু নির্বাচনের পরে এই গাড়ি দেওয়াই নয়, ভোটের সময়ও আসাদ সহায়তা নিয়েছেন মুকুলের। বিনিময়ে এমপি আসাদ প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগের পূর্বের বলয়কে টেক্কা দিয়ে সরিয়ে মুকুলের ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজকে রাজশাহীর দুটি বালুমহাল ইজারা পাইয়ে দেন বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

গাড়ির মালিকের আদ্যোপান্ত

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো টিএক্স মডেলের কালো রঙের ব্র্যান্ড নিউ এই গাড়িটি একই বছরের ৩ জুন ঢাকায় নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনের তথ্য অনুসারে, এই গাড়ির মালিকের নাম মো. মুখলেসুর রহমান, পিতার নাম মো. ওয়াজ নবী। গাড়িটির ফিটনেসের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে আগামী ১৯ আগস্ট ২০২৪।

বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় গাড়িটির মালিক রাজশাহীর মুখলেসুর রহমান মুকুল। ভারতের গরুপাচারকারী চক্রের মূল হোতা এনামুল হক ও তার তিন ভাগনের প্রতিষ্ঠান জেএইচএম গ্রুপের হুন্ডি চক্রের সঙ্গে মুকুলের সম্পৃক্ততা আলোচনায় আসে ২০২০ সালে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরবর্তীতে মুকুল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। আর সেই সুবাদে তার প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজ আমদানি রপ্তানি ব্যবসার পাশাপাশি রাজশাহী সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থায় ঠিকাদারি কাজেও জড়িত হয়। পরের বছর মুকুল রাজশাহীর সেরা করদাতার পুরস্কারও পান।

২০২০ সালে দুই দেশের গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি রপ্তানি ও ঠিকাদারি ব্যবসার আড়ালে মুখলেসুর রহমান মুকুল দীর্ঘদিন ধরে হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর জেএইচএম গ্রুপের তিন মালিক জাহাঙ্গীর, হুমায়ূন ও মেহেদী বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। রাজশাহী অঞ্চলে যার দেখভালের দায়িত্ব ছিল মুকুলের ওপর।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আড়ালে চলছে জেএইচএমের অর্থপাচার ও অবৈধ কারবার। ভারতের মুর্শিদাবাদের নাগরিক মেহেদী হাসানসহ তিন ভাই ও তাদের মামা এনামুল হকের ছত্রছায়ায় ভারত ও বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে হুন্ডি, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র পাচারের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক। মুখলেসুর রহমান মুকুল সেই নেটওয়ার্কের মূল কুশীলব। তার প্রতিষ্ঠান ‘মুন এন্টারপ্রাইজের’ নামে ভারত থেকে যেসব পাথর ও পেঁয়াজ আমদানি করা হয় তার প্রায় ৯৯ ভাগই হলো জেএইচএম ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড ও এমএস হক মার্কেন্টাইল প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হলো কলকাতার এম কে পয়েন্ট ফোর্থ ফ্লোর ও সিক্সথ ফ্লোর, বেনটিক স্ট্রিট। এম এস হকের মালিক জেএইচএমের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের মামা এনামুল হক। এই অফিসে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে নথিপত্র জব্দ করে। ইউনিভার্সাল নিউজের হাতে আসা তথ্যাদি ঘেঁটে দেখা যায়, ওই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ভারতে গ্রেপ্তারের পরও তাদের সঙ্গে ব্যবসা তথা লেনদেন চালিয়ে গেছেন মুকুল। এই চক্রটির হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে আসছে।

সূত্রমতে, জেএইচএম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেএইচএম ইন্টারন্যাশনাল এ বছরও ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশে কয়লা আমদানি করেছে। এর মধ্যে দুটি কয়লাবোঝাই নৌযান নওয়াপাড়ার কাছে ভৈরব নদে ডুবে যায়।

এদিকে এবার নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত জেনে মুকুল রাজশাহী-৩ আসনের প্রার্থী আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। আসাদ নির্বাচিত হলে নিজের বহু মূল্যবান গাড়িটি আসাদকে ব্যবহার করতে দেন।

গাড়ি ও সুবিধার বিনিময়ে মুকুল বাড়িয়েছেন ব্যবসা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই রাজশাহীর পবা ও গোদাগাড়ী উপজেলার বালুমহালসমূহের ইজারা দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্থানীয় প্রশাসন। দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুটি মহালের বালু উত্তোলন ও টোল আদায়ের ইজারা পায় মুকুলের মালিকানাধীন মুন এন্টারপ্রাইজ। একটির শুধু বালু উত্তোলনের ইজারা পায় প্রতিষ্ঠানটি।

বালু ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সংসদ সদস্য হওয়ার পর আসাদুজ্জামান আসাদ প্রভাব খাটিয়ে বালুমহালগুলোকে মুখলেসুর রহমান মুকুলকে পাইয়ে দেন। এর সঙ্গে যুক্ত হন আসাদের ভাই শফিকুজ্জামান শফিক। আসাদের প্রভাবে বালুমহাল ইজারা পেয়েই তারা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন বলে বালুব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন।

এদিকে বালুমহাল ইজারা পাওয়ার পর থেকেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। মহাসড়কের পাশে বালু রাখার জায়গা করতে উপজেলার সুলতানগঞ্জ এলাকার গাংগোবাড়ি মৌজার কয়েক একর জমির কাঁচা ধান নষ্ট করে ফেলা হয়। সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগও ওঠে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। যা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে জানান, রাজশাহীতে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে বালু সরবরাহের সিন্ডিকেট এখন মুকুলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি এই অঞ্চলের ধনীদের অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা করে থাকেন এই মুকুল। গোদাগাড়ী প্রেমতলি ঘাটের বালুর ট্রাক চলাচলের ফলে বাঁধ হুমকিতে রয়েছে। স্থানীয়রা আমাকে অভিযোগ দিয়েছেন। আমি এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় প্রধান প্রকৌশলীসহ এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে জানিয়েছি। তবে অদৃশ্য শক্তির বলে এখনও ওই স্থান দিয়ে বালুমহালের ট্রাক চলছে। এ থেকেই বোঝা যায় মুকুলের পেছনে বড় একটি শক্তি কাজ করছে। তার ব্যবাসায়ী পার্টনার কে তা খতিয়ে দেখলেই জানা যাবে তার পেছনে কারা অদৃশ্য শক্তি হয়ে কাজ করছে।

আসাদ প্রসঙ্গে এমপি ফারুক চৌধুরী বলেন, শুধু মুকুল না, গোদাগাড়ীর একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন যার বিরুদ্ধে মাদক চোরাকারবারের একাধিক অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের কাছে। সে শূন্য থেকে আজ কোটিপতি। তার সঙ্গেও আসাদ হাত মিলিয়ে চলছেন।

মুকলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ দাবি করেন, গাড়িটি মুকুলের ছিল, কিনে নেওয়া হয়েছে। তবে কত টাকায় গাড়িটি কেনা হয়েছে তা তিনি বলতে রাজি হননি। মুকুলের হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা প্রশাসন দেখবে।’ বালুর ঘাট ইজারসহ ব্যবসায়িক নানা সুবিধা প্রসঙ্গে এমপি আসাদ বলেন, ‘বিষয়গুলোর তদন্ত করে দেখা হোক। বালুর ঘাট এলাকাটা এমপি ফারুক চৌধুরীর। উনিই ভালো বলতে পারবেন।’ মুকুলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘মুকুল আমার এলাকার ছোট ভাই। আমি যাদের সঙ্গে চলি ওপেন চলি।’

এমপি গাড়িটি কিনে নেওয়ার দাবি করলেও এ বিষয়ে মুখ খোলেননি গাড়ির মালিক মুকুল। বিদেশে অর্থ পাচার বা হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে সেটাও তিনি অস্বীকার করেন। আর এমপি আসাদের ব্যবহৃত গাড়িটির বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি সাক্ষাতে কথা বলতে চান। এমনকি তিনি তার ব্যবসা প্রসঙ্গে তথ্য না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

এমপি আসাদের হলফনামা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজশাহী-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন সাড়ে ২৫ লাখ টাকা। পেশা ব্যবসা। ঠিকাদারি থেকে বছরে আয় সাড়ে সাত লাখ টাকা। এ ছাড়া মাছ চাষে আয় ১৮ লাখ টাকা। নির্বাচনের আগে হাতে নগদ টাকা ছিল ৫০ হাজার। তার তিনটি ব্যাংকে জমা আছে তিন হাজার ২০৬ টাকা। স্ত্রীর নামে ব্যাংকে জমা ছিল ৩১ হাজার ৭৯০ টাকা। এ ছাড়াও মেয়ে ও ছেলের নামে তিন লাখ ৪ হাজার ৬৮৮ টাকা ছিল।

নির্বাচনের আগে তার স্বর্ণ ছিল দুই লাখ টাকার। এ ছাড়াও প্রথম স্ত্রীর নামে স্বর্ণ ছিল ১৫ ভরি ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে স্বর্ণ ছিল ১০ ভরি। ইলেকট্রনিকস সামগ্রী দেড় লাখ টাকার আর আসবাবপত্রের মূল্য দেখানো হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকার। এ ছাড়াও বারনই আবাসিক এলাকায় কিস্তিতে নেওয়া একটি প্লট দেখানো হয় তার নামে, যার মূল্য ২০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এর বাইরে ১১ লাখ টাকার একটি ভবন ও ৩০ লাখ টাকার একটি মৎস্য খামার দেখানো হয় তার সম্পত্তির তালিকায়।

নির্বাচনের আগে টয়োটা এক্সিও মডেলের একটি ব্যক্তিগত কার ছিল তার, যার মূল্য দেখানো হয় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আসাদের ঘনিষ্ঠরা জানান, এই ব্যক্তিগত কারটি এখনও রয়েছে তার নামে। তবে তিনি চলাফেরা করেন একটি ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো টিএক্স গাড়িতে। বর্তমানে এই গাড়ির বাজারমূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।


শর্টলিংকঃ