ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ডা. মঈনের পরিবার


ইউএনভি ডেস্ক:

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে কোনও চিকিৎসকের মৃত্যু হলে বা আক্রান্ত হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম চিকিৎসক হিসেবে মারা যান ডা. মঈন উদ্দিন। তার পরিবার ক্ষতিপূরণ পেলেও মৃত অন্যদের বিষয়ে এখনও যাচাই-বাছাই চলছে।

গত ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, ‘মার্চ মাস থেকে যারা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছেন, আমি তাদের পুরস্কৃত করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘সরকার তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেবে। এছাড়াও দায়িত্ব পালনের সময় কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে তাদের জন্য ৫-১০ লাখ টাকার একটি স্বাস্থ্যবিমা থাকবে। কেউ মারা গেলে স্বাস্থ্যবিমার পরিমাণ পাঁচগুণ বেশি হবে।’ তবে মনে রাখবেন, এগুলো মার্চ মাসের পর থেকে যারা জীবনবাজি রেখে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে কাজ করছেন, তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে,’ উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, তার এ ঘোষণা সে সময় উৎসাহ দিয়েছে এ ভেবে যে, চিকিৎসকদের কথা প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন, এটা কেবল টাকার বিষয় নয়। এটা উৎসাহ দেওয়া, তাদের কথা মনে রাখা।

জানা গেছে, সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যারা ‘সরাসরি জড়িত’ তাদের নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, সরাসরি জড়িত বলতে মন্ত্রণালয় কী বোঝাতে চেয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি।

প্রসঙ্গত,সরকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবাদানকারী চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে থাকা মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে।

তাতে বলা হয়, ‘১৫ -২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে তিনি পাঁচ লাখ টাকা, আর মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ১০ থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাত লাখ, আর মারা গেলে পাবেন ৩৭ লাখ টাকা। আর প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ১০ টাকা, আর মারা গেলে তার জন্য ৫০ লাখ টাকা পাবেন’, বলে পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়।

আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অথবা বিভাগ থেকে আক্রান্ত বা মৃত্যুবরণকারীরা এই অর্থ পাবেন। অর্থ দেওয়া হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ করা করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ খাত থেকে। এজন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে। আর এ জন্য ৮০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে।

জানা যায়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিনের স্ত্রী চৌধুরী রিফাত জাহান গত ২৭ এপ্রিল সরকারের কাছে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগ তার ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠায়।

যোগাযোগ করা হলে ডা. মঈন উদ্দিনের স্ত্রী ডা. চৌধুরী রিফাত জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, কোরবানি ঈদের পর তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে। কোনও মানুষের ক্ষতিপূরণ কখনও হয় না, তবে কথা রেখেছে বলে সরকারকে ধন্যবাদ জানান ডা. চৌধুরী রিফাত জাহান।

তবে মৃত অন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘কোভিড -১৯ চিকিৎসায় সরাসরি জড়িত’ বলতে কেবল কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বুঝিয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেছে। আর সেটা যদি করা হয় তাহলে অনেক হাসপাতালের সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করা যোদ্ধারা এ প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই এসব বিষয় আরও সুনির্দিষ্ট করে বিবেচনা করা দরকার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, হিসাব করলে দেখা যাবে, করোনা ডেডিকেটেড নয় এমন হাসপাতালের চিকিৎসকদের আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছাড়া কম হবে না। বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, সার্জারি, মেডিসিন, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, রেডিওলজি বিভাগ, আইসিইউতে কাজ করা চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন। বেশ কয়েকটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধানরা মৃত্যুবরণ করেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে, অথচ সেগুলো কোভিড ডেডিকেটেড ছিল না।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, প্রতিমুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়কে পেছনে ফেলে জীবনবাজি রেখে কাজ করছি। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতালের দেওয়া নিরাপত্তা সামগ্রীর পাশাপাশি নিজেরাও আলাদা সামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে বেতনের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে এসবের পেছনে।

ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীরা প্রণোদনা ভাতা পেলেও কোভিড-১৯-এর প্রকৃত সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক ও নার্সরা এসবের কিছুই পাননি। উপরন্তু, নবনিযুক্ত ২০০০ চিকিৎসকের বেতন-ভাতা দাফতরিক জটিলতায় বন্ধ থাকার পর মাত্র চালু হলেও বেশিরভাগ চিকিৎসকই ঈদুল ফিতরের বোনাস এখনও বুঝে পাননি।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর গত ২৯ আগস্টের তথ্যানুযায়ী, চিকিৎসকসহ মোট সাত হাজার ৭৮৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত। এদের মধ্যে চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৬৮৮ জন, নার্স আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৯৩১ জন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ১৬৬ জন। এরমধ্যে করোনায় মারা গেছেন ৭৪ জন চিকিৎসক। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন সাত জন চিকিৎসক।

ঢাকার বাইরের একটি বিভাগীয় শহরে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক  বলেন, আমরা শুরু থেকেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। প্রথমে আমাদের কোয়ারেন্টিনের জন্য হোটেল দেওয়া হলেও সেটা এখন বন্ধ রয়েছে। বাসায় থাকতে হচ্ছে পরিবারের সব সদস্যদের ঝুঁকিতে ফেলে। সবার পরিবারেই বয়স্ক এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত বাবা-মা রয়েছেন, রয়েছে শিশু। কিন্তু এখনও কোনও প্রণোদনা আমরা পেলাম না। প্রণোদনা কেবল একটা সম্মানী নয়, এটা একটা উৎসাহও।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী  বলেন, ‘চিকিৎসকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি বিএমএ বা চিকিৎসকরা করেননি। সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে থেকে এই ঘোষণা করেছিলেন, এটা তার স্বপ্রণোদিত ঘোষণা ছিল। এটা অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ।’

বিএমএ মহাসচিব বলেন, ‘‘সরকার এগুলো ‘কম্পাইল’ করছে বলে মনে হয়। ক্ষতিপূরণ নিশ্চয়ই যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে। হয়তো শুরুতে একজন বা দুজনকে একটা টোকেন হিসেবে দেওয়া হবে। এরপর হয়তো বা পর্যায়ক্রমে সেটা দেওয়া হবে।’’

তিনি বলেন, ‘অধিদফতর থেকেও মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র দেওয়া হচ্ছে। আমরাও তাদের সহযোগিতা করছি এ সংক্রান্ত বিষয়ে। সবাই মিলেই মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু আলমেটলি সেটা যাচাই-বাছাই করবে অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়।’

আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ ( স্বাচিপ)-এর মহাসচিব ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘প্রথম মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। বাকিদের বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আপাতত করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর করোনা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সম্প্রতি রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজির কেলেঙ্কারির পর করোনা পজিটিভ সনদ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই এ নিয়ে আরও যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর কমিটমেন্ট ছিল চিকিৎসকদের প্রণোদনা, এটা হবেই। যে যা পাওয়ার সেটা সে পাবেই। যে প্রসেসে পাওয়ার কথা, আবেদন করলেই পাবেন।’


শর্টলিংকঃ