জারিনাদের জীবন


জারদের স্ত্রীরা কোন কাজটি করতে পারেননি? তবে যদি এভাবে প্রশ্ন করা হয় তারা কী কী করতে পারতেন, তাহলে উত্তরটা অনেক সহজ হতো। আসলে অনেক কিছুই তারা করতে পারতেন না। মাঠে হাঁটতে যাওয়া কিংবা ফুল তোলা, দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়া, আত্মীয়দের বাসায় যাওয়ার মতো জীবনের অনেক স্বাভাবিক কাজ একজন রুশ সম্রাজ্ঞী বা জারিনার জন্য ছিল নিষিদ্ধ। রুশ জারবংশীয়রা কালো জাদুকে খুব ভয় পেতেন। সে কারণে জারিনাদের জীবনের একটা বড় অংশ কেটে যেত ঘরের কোণে।

আইভান দ্য টেরিবলের সময় থেকে বিয়ের জন্য পাত্রী নির্ধারণ করা হতো কনে মেলা থেকে। বাইজান্টিয়াম থেকে প্রথাটি রাশিয়ায় হাজির হয়েছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সবচেয়ে সুন্দরী কনেদের মস্কোয় আনা হতো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এদের মধ্য থেকে উপযুক্ত কনে বাছাই করা হতো। শেষমেশ কনের আভিজাত্য কিংবা ধনদৌলত কোনো ভূমিকা রাখত না, কেবল তার সৌন্দর্য এবং সুস্বাস্থ্যই ছিল মূল বিচার্য।

ছয় থেকে সাতজন বাছাইকৃত কনেকে জারের চেম্বারে উপস্থাপন করা হতো এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকে জার নিজের স্ত্রী হিসেবে বেছে নিতেন। জার বাছাই করার পর কনে জারিনা হিসেবে মনোনীত হতেন।

আইভান দ্য টেরিবল (১৫৩০-৮৪)-এর প্রথম স্ত্রী আনাস্তাসিয়া (১৫৩০-৬০)। ধারণা করা হয় বোয়ারদের (একটি রুশ অভিজাত গোষ্ঠী) নির্দেশে তাকে কালো জাদু করা হয়েছিল। এ কারণে আইভান তাদের অনেককে নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। জার তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রীও মারা গিয়েছিলেন বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই।

তৃতীয় স্ত্রী মারফা সোবাকিনা ১৫৭১ সালে বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই মারা যান (ফলে মারফার আত্মীয়স্বজনসহ অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল)। বিষ প্রয়োগেই সম্ভবত তার মৃত্যু হয়েছিল। রাশিয়ানরা ওষুধ তৈরিতে অনেক ধরনের বিষাক্ত উদ্ভিদ ব্যবহার করত। ধারণা করা হয় এ রকম কোনো একটি ওষুধের মাধ্যমেই তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

মারিয়া খ্লোপোভা (মৃত্যু-১৬৩৩) ছিলেন মিখাইল ফিয়োদোরোভিচের প্রথম স্ত্রী। মিখাইল ছিলেন হাউজ অব রোমানভ (১৫৯৬-১৬৪৫)-এর প্রথম জার। তার সঙ্গে বাগদানের কিছুদিন পরেই মারিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বেশ কয়েক দিন ধরে বমি করতে থাকে। এতটুকুই যথেষ্ট ছিল বোয়ারদের কর্তৃক তাকে বিয়ের অযোগ্য প্রমাণ করতে এবং এ বিয়ে বাতিল করা হয়।

মিখাইলের দ্বিতীয় স্ত্রী মারিয়া ডোলগোরুকায়া (১৬০৮-২৫) মারা যান বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায়। এরপর মিখাইল যখন তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে ইভদোকিয়া স্ট্রেশনেভাকে নির্বাচন করেন, তখন তাকে প্রাসাদে এনেছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানের মাত্র তিনদিন আগে। তার মনে আশঙ্কা ছিল ইভদোকিয়াকেও প্রাসাদে বিষ প্রয়োগ করা হতে পারে।

অনেকেই তরুণী জারিনার মৃত্যু কামনা করত, বিশেষ করে সেসব পরিবার যাদের মেয়েদের জারিনা হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেনি। পরবর্তী সময় সপ্তদশ শতাব্দীতে জারিনা ও জার পরিবারের অন্য নারীদের জীবন রক্ষায় শক্ত কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।

অভিজাত বংশের কোনো মেয়ে জারিনা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আর আত্মীয়দের বাসায় যেতে দেয়া হতো না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ, সাক্ষাৎ একরকম নিষিদ্ধই ছিল। মূলত এসব তাদের জন্য এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। তাই জারিনার বাবা-মা এবং অন্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের জারের প্রাসাদে নিয়ে এসে তাদের রাজসভাতে উচ্চপদ প্রদান করা হতো।

ক্রেমলিনে জারদের কাঠের প্রাসাদটি ছিল বিরাট আকারের, যেখানে কক্ষের সংখ্যা ১০০-এর বেশি এবং এর অর্ধেক ছিল নারীদের জন্য সংরক্ষিত। জারিনা ও তার মেয়েরা দরবারের যেসব অনুষ্ঠানে পুরুষদের উপস্থিতি থাকত, সেখানে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তবে তাদের নিজস্ব আনুষ্ঠানিক হল থাকত, যা গোল্ডেন জারিনা’স চেম্বার নামে পরিচিত ছিল।

জারিনা এখানে তার সিংহাসনে বসে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবের দিন এবং নিজেদের আরাধ্য সাধুর জন্মদিনে অতিথিদের স্বাগত জানাতেন। একমাত্র এ দিনগুলোতেই জারিনা অপরিচিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারতেন। যাদের মধ্যে থাকতেন—পাদ্রি, অভিজাত ঘরের সদস্য এবং তাদের স্ত্রীরা। জারিনা ও তার কন্যারা যখন মস্কোর বাইরে অবস্থিত খ্রিস্টীয় মঠে যেতেন, তখন তাদের বাহন হতো বদ্ধ ক্যারিজ। তারা যখন ক্যারিজ থেকে নেমে গির্জায় ঢুকতেন, তখন চাকর-বাকররা তাদের চারপাশে মখমলের পর্দা তুলে ধরত, যেন আশপাশের সাধারণ কেউ তাদের না দেখতে পারেন।

জারিনাদের চেম্বারে তাদের সেবায় নিয়োজিত সব কর্মচারী ও ভৃত্য ছিল নারী। ভৃত্যদের নেতাদের ডাকা হতো বয়ারিনাস (বোয়ারের স্ত্রী)। তারা মূলত জারিনাদের আর্থিক বিষয়াদিসহ, তাদের খাদ্য এবং সাজসজ্জার বিষয়গুলো দেখভাল করত। বয়ারিনাসদের একজন চেম্বারের অভ্যন্তরের সব দ্বন্দ্ব এবং অপরাধ দমন ও বিচারিক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। যদিও কালো জাদু করার মতো গুরুতর অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হলে তা রাজনৈতিক বিষয়াদি তদন্তের জন্য প্রতিষ্ঠিত ভয়ংকর প্রিভি প্রিকাজে স্থানান্তরিত করা হতো। প্রতিষ্ঠানটির তদারকি করতেন স্বয়ং জার।

১৬৩৮ সালে জারিনার লন্ড্রি চেম্বারে কর্মরত একজন ভৃত্য ডারিয়া লামানোভার বিরুদ্ধে জারিনার অন্তর্বাস কাপড় চুরির অভিযোগ ওঠে। পরে তদন্তে উঠে আসে ডারিয়া কালো জাদুকর নাসতাসায়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল। আরো জানা যায় এ ডারিয়া প্রাসাদ চত্বরে জারিনা এভডোকিয়ার রেখে আসা পায়ের ছাপে ছাই ছিটিয়েছিলেন—কাজটিকে কালো জাদু দিয়ে কাউকে অভিশপ্ত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে জারিনাকে অভিশপ্ত করা! এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব মেয়েকে প্রিভি প্রিকাজে জেরা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় তাদের সবাই নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে।

বয়ারিনাসরা ছাড়াও জারিনাদের সেবায় আরো অন্তত ৫০ জন ভৃত্য কাজ করত, তবে এরা কেউ প্রাসাদের অভ্যন্তরে বাস করত না। অভিজাত ঘরের অনেক মেয়ে প্রাসাদে জারদের কন্যাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহকর্মী হিসেবে বেড়ে উঠত। এছাড়া অন্যান্য কাজের জন্য বিপুলসংখ্যক নারী ভৃত্য তাদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। তারা জারিনাদের বিছানা গোছানোসহ খুব ছোট কাজ যেমন কাপড় ধোয়া এবং গোছানোর কাজ করতেন।

বিশেষ কাজ যেমন, উচ্চস্বরে বই পড়ে শোনানো, ধর্মীয় স্তবক পাঠ এবং বিনোদনের জন্য জারিনারা বামন ও ভাঁড় মেয়েদের নিয়োজিত করতেন। প্রাসাদে অবশ্য পুরুষ কর্মীরাও কাজ করত। প্রথমত, তারা ধর্মযাজক হিসেবে জারিনার কক্ষে যেতে পারতেন। জারের মতো জারিনারও হাউজ চার্চ ছিল এবং শয়নকক্ষের সঙ্গে তাদের প্রার্থনা গৃহ থাকত।

কয়েক ডজন উঠতি বয়সী (১০-১৫ বছরের মধ্যে) ছেলে টেবিলে জারিনা এবং তাদের মেয়েদের সাহায্যে নিয়োজিত থাকত। যখন তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠত, তখন প্রাসাদ থেকে এ ছেলেদের বের করে দেয়া হতো। অন্তত ১০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ জারিনাদের নিরাপত্তায় প্রাসাদে নিয়োজিত থাকত। প্রাসাদের অভ্যন্তরে তাদের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। যখন কোনো মেয়ে প্রাসাদে থাকত না, তখন তারা কেবল ভেতরে প্রবেশ করতে পারত।

গির্জা এবং ধর্মীয় উপাসনালয় পরিদর্শন ছাড়াও জারিনারা কিছু সেবামূলক কাজ করতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিজাত নারী-পুরুষরা তাদের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ জারদের কাছে না পাঠিয়ে জারিনাদের কাছে পাঠাতেন। যেহেতু রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত ছিল, তাই তারা জারদের অনুমতিসাপেক্ষে কিছুক্ষেত্রে বিচারিক কাজে জারিনারা অংশ নিতে পারতেন।

জারিনারা অনেকটা সময় ব্যয় করতেন উচ্চমানের পোশাক তৈরিতে এবং বেশির ভাগ সময়েই তারা নিজেরাই এমব্রয়ডারি করতেন। রাশিয়ান রাজপরিবারের থেকে রাষ্ট্রদূত কিংবা শাসকদের রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে জারিনাদের তৈরি উত্তরীয় ছিল খুবই সম্মানজনক উপহার। জারিনাদের বিকালের সময়টা কাটত জার ও পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে। তারা দাবা খেলতেন, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মীয় বই পাঠ করতেন।

তারা পরিব্রাজক এবং ধর্মযাজকদের কাছ থেকে গল্প শুনেও সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। জাররা জারিনাদের কক্ষে রাত কাটাতেন খুব কম, কারণ বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হতো।

পিটার দ্য গ্রেট (১৬৭২-১৭২৫)-এর সময়ে জারিনাদের চেম্বার প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তার মা নাটালিয়া নারিশকিনা (১৬৫১-৯৪) প্রথম রুশ জারিনা, যিনি প্রথম থিয়েটারে গিয়ে মঞ্চায়ন দেখেছেন। তিনি নাচতে ভালোবাসতেন এবং কূটনৈতিক অভ্যর্থনায় অংশ নিতে পছন্দ করতেন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই চেম্বার প্রথা ভাঙতে পেরেছিলেন। তার পুত্র সন্তান ক্রমান্বয়ে প্রাসাদের বিভক্তিমূলক নিয়মকানুন নিষিদ্ধ করেছিলেন। আঠার শতকের মধ্যে রুশ জার শাসকরা অনেকটাই ইউরোপিয়ান রাজসভার রীতিনীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন।

 

সূত্র: রাশিয়া বিয়ন্ড


শর্টলিংকঃ