জেব-উন-নিসার ‘দিওয়ান-ই-মাকফি’


ভারতীয় ফারসি সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘দিওয়ান-ই-মাকফি’। পিতা ভারত সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বন্দি হয়ে জীবনের শেষ কুড়িটি বছর দিল্লির সালিমগড় দুর্গে নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন শাহজাদী জেব-উন-নিসা। মৃত্যুর প্রায় ৩২০ বছর পরও তাকে যেকোনো সাম্রাজ্যের কোনো রাজকন্যার চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিমান করে টিকিয়ে রেখেছে তার মরণোত্তর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-ই-মাকফি’। নিজেকে অজ্ঞাত রাখতে তিনি মাকফি নামটিই নিয়েছেন। মাকফি মানে লুকানো বা গুপ্ত একজন। মনোযোগ দিয়ে এ কাব্যগ্রন্থ যিনি পড়বেন, ভালোবাসার বেদনা তাকে অশ্রুশিক্ত না করে পারে না।

সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং তার প্রথম স্ত্রী দিলরাজ বানু বেগমের শ্রেষ্ঠ কন্যা জেব-উন-নিসার জন্ম ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৮; তিনি ঐতিহ্যবাহী ছকে সাজানো রাজকন্য হয়ে জীবনযাপন করতে চাননি বলেই বিদ্রোহ করেছেন, বাবার দর্শনবিরোধী কথা দিয়ে নিজের কবিতার পঙিক্ত সাজিয়েছেন। ৬৪ বছর বয়সে ২৬ মে ১৭০২ সালিমগড় দুর্গে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ রাজকন্যাদের ছিল না কিন্তু তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে ফারসি, আরবি ভাষার পাঠ নিয়েছেন, দর্শন, সাহিত্য, মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সে সময় জেব-উন-নিসার ব্যক্তিগত পাঠগারে দর্শন, আইন, ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্য বিষয়ে এত বই ছিল যে এ রকম সমৃদ্ধ পাঠাগার তখন কমই ছিল। তিনি যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন তার সময়কার বিখ্যাত ভারতীয় কবিরা হচ্ছেন, মওলানা আবদুল কাদের, কলিম কাশানি, খায়ের তাবরিজি এবং গনি কাশ্মীরী। মাকফি নামের আড়ালে তিনি প্রায় পাঁচ হাজার ফারসি কবিতা লিখেছেন। মোনিস-উল-রুহ, জেব-উল-মনশাত এবং জেব-উল তাফাসির নামের ফারসি গ্রন্থ রচনা করেন। তার কবিতার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন।

সম্রাজ আওরঙ্গজেব যখন একাধিক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের পর সম্রাট শাহজাহানের থেকে ক্ষমতা নিয়ে দিল্লির সম্রাট হলেন রাজকুমারীর বয়স তখন ২১ বছর। শাহজাহান তার বড় ছেলে দারা শুকোর ছেলের সঙ্গে জেব-উন-নিসার বিয়ে দিতে চেয়েছেন। আওরঙ্গজেব তা অনুমোদন করেননি। লাহোরের গভর্নরের পুত্র আকিল খান জেব-উন-নিসার প্রণয়প্রার্থী ছিলেন, আওরঙ্গজেব বাধা দিয়েছেন। আওরঙ্গজেব কেন তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন এ নিয়ে কয়েকটি ভিন্ন মত রয়েছে: একটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিজেকে জড়িয়েছেন, আওরঙ্গজেব জীবদ্দশায় ক্ষমতা গ্রহণের জন্য তার ছোট ভাইকে প্ররোচিত করেছেন। তার লেখাতে বাবার ধর্মমতের বিরুদ্ধে কিছু কথা আছে যা বিপজ্জনক। তিনি প্রেম করেছেন যা অবৈধ সম্পর্কের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তিনি সংগীতচর্চা করতেন, যা সম্রাটের মনঃপুত ছিল না। সম্ভবত অনেক বিষয় বিবেচনা এনেই তাকে কারাবন্দি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের অনেক গৌরবগাথার মধ্যে ভ্রাতৃহত্যার নির্মমতার সঙ্গে জেব-উন-নিসার প্রণয়প্রার্থী দারা শুকোর পুত্র সোলায়মান শুকোকে গোয়ালিয়রে হত্যা করার নির্দেশ তারই, সে কথাও বলা হয়। তার ফুফু সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারাও কবিতা লিখতেন। জেব-উন-নিসার কয়েকটি কবিতা/কবিতাংশ অনূদিত হলোঃ

***

আমি যদিও পারস্য রোমঞ্চের লায়লা

আমার অন্তর ক্ষিপ্ত মজনুর মতো ভালোবাসে

আমি মরুভূমিতে ছুটে যেতে চাই কিন্তু

লজ্জা আমার পায়ে শেকল বেঁধে রাখে

ফুল বাগানে একটি বুলবুলি আসে

কারণ বুলবুলি আমার শিষ্য ছিল অনুগত

ভালোবাসার ব্যাপারে আমিই ছিলাম পারদর্শী

এমনকি শুয়োপোকাও আমার শিষ্য।

 

যতদিন না স্বর্গীয় ভালোবাসা এসে হাজির হবে, তিনি তার অবগুণ্ঠন খুলবেন না—এ আলংকারিক বর্ণনাটি জেব-উন-নিসার প্রিয় ছিল। একবার তার প্রেমমগ্ন নাসির আলী তাকে বলেছিলেন: ‘চাঁদও যাকে ঈর্ষা করে হে নারী, তোমার ঘোমটা উঠাও আর আমাকে উপভোগ করতে দাও তোমার সৌন্দর্যের বিস্ময়।’ সে কথার জবাবে রচিত হলো ক’টি স্মরণীয় প্রেম পঙিক্ত:

আমি আমার ঘোমটা উঠাব না

যদি উঠাই তাহলে কী হবে কে জানে?

বুলবুল ভুলে যেতে পারে তার গোলাপ

আমার সৌন্দর্য বিরাজ করতে পারে।

ভাবুন কেমন করে নিকুঞ্জে ফুলের ভেতর

তার সুঘ্রাণ আত্মা থাকে, কেউ দেখতে পায় না

পৃথিবীও আমাকে দেখবে আমার লেখা পঙিক্ততে

আমি আমার ঘোমটা উঠাব না।

 

***

আওরঙ্গজেব তখন জেব-উন-নিসাকে সালিমগড় দুর্গে বন্দি করে রেখেছিল। তিক্ত যাতনা থেকে তিনি লিখলেন:

যতক্ষণ এ শেকল আমার পা আটকে রাখে!

আমার বন্ধুরা শত্রু হয়ে গেছে

আমার আত্মীয়রা আমার কাছে আগন্তুক

আমার বন্ধুরা যখন আমাকে অপদস্ত করতে চায়

আমার নামের অসম্মানের উদ্বেগ থেকে বাঁচতে

আমাকে আর কী কী করতে হবে।

হে মাকফি যাতনার কারাগার থেকে মুক্তি চেয়ো না

তোমার মুক্তি সুবিবেচনা প্রসূত হবে না

শেষ বিচারের আগে হে মাকফি

মুক্তির কোনো আশা নেই।

 

***

এমনকি মজনুর কবর থেকে সে ধ্বনি আমার কানে আসে

ওহ লায়লা ভালোবাসার যে শিকার কবরেও তার নিস্তার নেই।

আমি তো সারাজীবনই ব্যয় করছি, দুঃখ আর অনুতাপ

আর আশা না মেটার অশ্রু ছাড়া আর কিছু পাইনি

মাকফি, তোমার নির্বাসন দীর্ঘকালের, দীর্ঘ তোমার মুক্তির প্রত্যাশা,

দীর্ঘকাল তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, তোমার ভেতর জ্বলবে

তোমার অন্তর, তোমার বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে চেয়ে; কিন্তু

হতভাগী এখন কী অবস্থায় আছে তোমার বাড়ি?

বহু বছর শূন্য পড়ে আছে তোরণ দিয়ে বয়ে গেছে

বহু বছরের ধুলো; পুনরুত্থানের দিন ঈশ্বর বলবেন

আমি তোর যাতনা সঠিক অনুপাতে পুষিয়ে দেব—কিন্তু

স্বর্গের সব আনন্দও তার চেয়ে অনেক কম।

 

***

আমার হূদয়ের সব সম্পদ লুট হয়ে গেছে

অযত্নে অরক্ষিত পড়ে আছে আমার হূদয়

আমাকে লজ্জায় ফেলে-আমি কাঁদতে থাকি

নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে-জানি দোষটা আমারই

আমার নিজের হাতে বেদীর সলতের আগুন দিই

আমার হূদয়ের ভেতরের প্রদীপ অগ্নিশিখা হয়ে উঠে

যে শরীর দেহ ধরে রেখেছে জ্বল জ্বল করে

আকাঙ্ক্ষা দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

আমার বোকা হূদয়টাকে যদি ভস্মীভূত করতে পারতাম

আমি বিশ্রাম নিতে পারতাম, দুঃখ কমে আসত

তোমার ভালোবাসার কাছে আমি ফিরে আসি

শান্তি পেতে শান্তির খোঁজে সেখানে।

 

***

তোমাকে ভালোবেসে বুলবুলি গান গায়

যে গুটিপোকা জ্বালায় তার সিল্কের ডানা

তোমার ভালোবাসা আগুনের কাছে টেনে এনেছে

আর দেখো, তোমার আকাঙ্ক্ষার মর্দ

সব পেয়ালার ঠোঁটে ঝুলে আছে

স্বস্তি নেই, নিষ্কৃতি নেই কোথাও

এখন আমার বেলায় তোমার ফাঁদে

অন্ধের মতো কিংবা স্বেচ্ছায় আমি আটকা পড়ি

কোনো স্বাধীনতা আর আমার নেই

তোমার চুলের শেকল আমাকে বেঁধে রাখে

এতো অশ্রু ঝরেছে আমার

তোমার হূিপণ্ড থেকে এতো রক্তের ধারা

এখন আমার চোখে আর কাঁদতে পারে না

ঝর্ণাও প্রপাতে ব্যর্থ হয়

যে উৎস থেকে আসত তা শুকিয়ে গেছে

হে মাকফি, প্রেম ও উপশমহীন বাসনার

আগুনে জ্বলে, বেদনায়, দুলতে দুলতে

অস্ফুট ভালোবাসার গোপন কথা বলেছো

তখন তোমাকে তার কঠিন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

 

আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক


শর্টলিংকঃ