টুপি-আতর বেঁচে সংসার চালান মুক্তিযোদ্ধা মকলেছুর


আমানুল হক আমান, বাঘা:

বাবা-মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে যান কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ২১ বছর বয়সী মকলেছুর রহমান। যুদ্ধ শেষে বীরের বেশে বাড়ি ফেরেন। তবে কিছুদিন পরই রাজশাহীর বাঘায় বেড়াতে এসে পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করেন তিনি। মেয়ের বাবা ‘রিফিউজি’ হওয়ায় তা মেনে নেন নি মকলেছুর রহমানের অভিমানী বাবা গোলাম রহমান।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাধ্য হয়ে রাজশাহীর বাঘায় শ্বশুরালয়ে সংসার পাতেন মুক্তিযোদ্ধা মকলেছুর। স্বীকৃতি আর সার্টিফিকেটের জন্য দৌঁড়ান নি তিনি। ফলে তার নেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপত্র। প্রথম দিকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছিলেন মকলেছুর রহমান। তবে ১৯৮৮ সালের প্রথম দিক থেকে শুরু করেন আতর-সুরমা ও টুপির ব্যবসা। ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন মকলেছুর।

তাঁর দুই ছেলে রয়েছে। তবে বিয়ে করার পর পৃথক সংসার করছেন ছেলেরা। ফলে স্ত্রীকে নিয়ে দুই জনের সংসার চালাতে হচ্ছে ৬৮ বছর বয়সী মকলেছুর রহমানকেই। বাঘা উপজেলার আড়ানী মোমিনপুর গ্রামে কুঁড়ে ঘরে বসবাস করেন মকলেছুর-জীবন নেছা দম্পতি।

যৌবনে কাজ করতে পারলেও এখন আর কুলিয়ে ওঠেন না তিনি। ফলে স্ত্রীকে নিয়ে এক বেলা খেয়ে দিন কাটে তাঁর। বাঘা উপজেলার আড়ানী বাজারের মূল গলিতে টেবিলের উপর কিছু আতর-সুরমা-টুপি নিয়ে রোজ বিক্রি করতে দেখা যায় তাঁকে।দোকান থেকে দিনে ৮০ থেকে ১০০ টাকা আয় হয়।

পাশাপাশি বৃদ্ধ বয়সেও রং মিস্ত্রির কাজ করেন। তবে শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় কাজে নিতে চান না অনেকে। ফলে অসুস্থ্য স্ত্রীর প্রতিদিনের ৪৮ টাকার ঔষধ কিনতে ধার-দেনাও করতে হয় তাঁকে।

মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ তম বছরে এসে বাধ্য হয়ে স্বীকৃতি আর সরকারি সহায়তা পাওয়ার প্র্রত্যাশা করছেন মকলেছুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে গেছি। বাবা-মাকে জানিয়েও যায় নি। বাড়িতে ফিরলে মা আর কান্নাকাটি করেছে, বকেছে। আবার আদরও করেছে।’

মকলেছুর রহমান বলতে থাকেন, প্রথম দিকে অনেকেই সার্টিফিকেট নিতে বলতো। আমি ভাবতাম ওসব নিয়ে কী হবে? দেশ স্বাধীন করেছি, স্বাধীন দেশে বসত করছি। এটাই তো আমাদের চাওয়া-পাওয়া ছিল। কিন্তু অনেকেই আছে, তারা ময়দানে যুদ্ধ করেনি। হয়তো কোনোভাবে সহায়তা করেছে, তারা আজ সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারি সুবিধা নিচ্ছে। আমরা কিছুই পাচ্ছি না।’

যুদ্ধে যাওয়ার দিনগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন, রেডিও তো শুনতাম যুদ্ধ সম্পর্কে। একপর্যায়ে বাড়িতে বললাম। কিন্তু সবাই খুব ভয় দেখালো। আব্বা রাগ করলো। তার দুই দিন পর বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পরিচিত অন্যদের সঙ্গে কেমনে কেমনে জানি ভারতে চলে যায়। সেখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়। ফিরে আসি কুষ্টিয়াতেই। ওখানে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দুই মাসের মতো সময় আমরা যুদ্ধ করি।’

মুক্তিযুদ্ধে বীরের বেশে জয়ী হয়ে ফিরলেও জীবনযুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত বলে জানালেন মকলেছুর রহমান। বলেন, ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। ছেলেরা সব আলাদা। বাড়িতে বউ আছে, তার জন্য খাওয়ার খরচের চেয়ে ঔষধের খরচ বেশি। শেষ বয়সে আর শ্রম দিতে পারছি না। সরকার যদি কোনোভাবে একটু সহায়তা করতো তবে জীবনের শেষ দিনগুলো স্বাধীন দেশে শান্তিতে কাটাতে পারতাম।’ তবে এরজন্য কারও পা ধরতে পারবেন না বলে জানান স্বীকৃতি না পাওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

জানতে চাইলে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন রেজা বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ কখনও আমাদেরকে জানাইও নি। উনি নিজেও কখনও বলেন নি। তবে যেহেতু জানলাম- বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা হবে। যদি উনি মুক্তিযুদ্ধ করেন, তবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’


শর্টলিংকঃ