প্রচারের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য


ইউএনভি ডেস্ক:

প্রজনন স্বাস্থ্য পুরুষ-নারী সকলের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে এ সংক্রান্ত আলোচনা। দেশের সংস্কৃতিতে যৌন ও প্রজনন ইস্যুটি এতটাই স্পর্শকাতর যে এ সম্পর্কে আলোচনা করাকে এখনও লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয়। অবস্থা এমন যে এ সংক্রান্ত আলোচনাকেও এখনও লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘প্রজনন স্বাস্থ্য শুধুমাত্র প্রজননতন্ত্রের কার্য ও প্রজনন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত রোগ বা অসুস্থতার অনুপস্থিতিকেই বোঝায় না, এটা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণকর এক পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পাদনের একটি অবস্থাকে বোঝায়।’

প্রজনন স্বাস্থ্যের ধারণা শুধুমাত্র মাতৃস্বাস্থ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রজনন স্বাস্থ্যের পরিচর্যা যে কোনো বয়সের নারী ও পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। প্রজনন স্বাস্থ্য়ের যত্ন গর্ভবতী মায়েদের চাহিদা পূরণ করলেও যারা গর্ভধারণ করতে চায় বা চায় না তারাও এর আওতাভুক্ত। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে ‘Collective initiatives to improve Menstrual Health (MH) situation in Bangladesh by engaging NGOs, civil society and private sector’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘নারী প্রগতি সংঘ’।

প্রকল্পটির পরিচালক নাসরিন বেগম বলেন, ‘প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মনে করা হয় নারীদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী যত্ন নেওয়াই প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার আওতাভুক্ত। কিন্তু একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব প্রতিটি স্তরেই প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত। অর্থাৎ, শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের সকল নারী-পুরুষই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় পড়ে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু নারীর বিষয় নয়, বরং নারী-পুরুষ উভয়েরই একটি কল্যাণকর স্বাস্থ্য সেবা।’

বস্তুত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার হলো মানবাধিকার। ২০১৬-২০৩০ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় বিষয়টিকে শুধু নারীদের মনে করে বেশিরভাগ পুরুষ এতে দৃষ্টিপাত করেন না। সমাজ-সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক কুসংস্কার, পরিবার থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না পাওয়া, ধর্মীয় গোঁড়ামি, শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক চর্চা ইত্যাদি কারণে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে ব্যাপক অসচেতনতা রয়েছে।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুন নাহার বলেন, ‘ক্ষমতার চর্চা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সহিংসতা ইত্যাদি পুরুষতান্ত্রিকতাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। ফলে যাবতীয় নেতিবাচক সবকিছু নারীর উপরে এসেই পড়ছে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও একান্ত নারীর বিষয় বলে পুরুষের অংশগ্রহণকে সীমিত করা, যা কেবলই দায়সারা।’

দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ডা. কল্লোল চৌধুরী বলেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে বিজ্ঞানভিক্তিক শিক্ষার অভাবে বাল্যবিয়ে, কম বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত, অনিরাপদ মাতৃত্ব, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, যৌনবাহিত রোগ ইত্যাদি ঘটছে অহরহ। তাই বিয়ে, মাসিক, কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিক, শারীরিক পরিবর্তন, অনিরাপদ যৌন মিলন, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রত্যেকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপপরিচালক শাহনাজ সুমী বলেন, ‘কোনো একটি গোষ্ঠীর চাপ কী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এটা কী রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক? যিনি করতে চান, তিনি করতে পারেন। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আসলে আমাদের প্রয়োজন সদিচ্ছার।’

সিমাভি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মাহবুবা হক কুমকুম বলেন, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়- প্রজনন অঙ্গ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সুস্থ ও সঠিক ধারণা থাকলে সেটি কিশোর-কিশোরীর পরবর্তী মানসিক গঠনে সাহায্য করে। তবে বাংলাদেশের সমাজে যুগ যুগ ধরে চলা সামাজিক জড়তার কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোনো জ্ঞান ছাড়াই পার করছেন। তার ফলাফলও আমরা প্রত্যক্ষ করছি।’

এসময় তিনি বেশি বেশি প্রচারণার মাধ্যমে এসব বিষয় বার বার সামনে আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও এইডস বিষয়ক কর্মসূচির আদলে এই বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দেন।


শর্টলিংকঃ