রাজশাহীর স্কুলগুলোতে দ্বিগুণ দামে কেনা হচ্ছে হাজিরার যন্ত্র


নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র স্থাপনের আগেই বাজার মূল্যের প্রায় দ্বিগুন দামের রশিদ শিক্ষকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কড়া নির্দেশনা থাকা সত্ত্বে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই এই যন্ত্র কিনতে শিক্ষকদের বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।এর দাম ধরা হচ্ছে ১৯ হাজার টাকা। ‘ডিজিটাল সলিউশন লিমিটেড’ নামের এটি প্রতিষ্ঠান এটি সরবরাহ করছে।


ইতিমধ্যেই একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ডিজিটালহাজিরা যন্ত্র কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে গত ২৩ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সকল বিভাগীয় উপপরিচালক, সকল জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষাকর্মকর্তা, মন্ত্রণালয়ের সিস্টেম এনালিস্টকে একটি নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এতে যন্ত্রটির ১৫টি ‘স্পেসিফিকেশন’ দিয়ে বলা হয়েছে, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে যাচাই করে সাশ্রয়ী মূল্যে নিজেদের পছন্দমতো ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র ক্রয় করে বিদ্যালয়ে স্থাপন করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

তারা জানতে পেরেছেন জেলা/ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে এই যন্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে বাধ্য করছেন। চিঠিতে আরও জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানানো যাচ্ছে যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এইরূপ কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি। স্ব-স্ব বিদ্যালয় অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সাশ্রয়ী মূল্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র ক্রয় করে বিদ্যালয়ে স্থাপন করবে। এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরের দিনই প্রাথমিক শিক্ষার রাজশাহী বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়।

এরপরেও এই নির্দেশ অমান্য করে রাজশাহীতে এই যন্ত্র কেনা শুরু হয়েছে। প্রথমেই রাজশাহীর তানোর উপজেলায় এটি শুরু করা হয়েছে। উপজেলার ১২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের হাতে যন্ত্র স্থাপনের আগেই ‘ডিজিটাল সলিউশন লিমিটেড’ নামের এটি কোম্পানির ১৮ হাজার ৯৯৯ টাকার রশিদ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের নাম, ঠিকানা ও ওপরে তারিখ লেখার জায়গা ফাঁকা রেখে এই রশিদের নিচে স্বাক্ষর দেওয়া হয়েছে। কোম্পানির সত্বাধিকারীর নাম ফয়সাল ইসলাম। এই নামেই স্বাক্ষর দেওয়া হয়েছে।


একজন প্রধান শিক্ষক জানান, তাদের কাছে যন্ত্রটি ফেরি করে বিক্রি করার জন্য বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা আসছিলেন। তারা ৯ থেকে ১৩ হাজার টাকার মধ্যে এই যন্ত্রটি তাদের সরবরাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওপর থেকে তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যন্ত্র বসানোর আগেই তাদের হাতে ডিজিটাল সলিউশন লিমিটেড’এর ১৮ হাজার ৯৯৯ টাকার রশিদ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর তানোর উপজেলার ১২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তানোরে সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জোবাইদা খানম প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকতার দায়িত্বে ছিলেন।জানতে চাইলে তিনি গত বুধবার  বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষকেরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একটি কোম্পানির কাছ থেকে নিলে তদারিকটা সহজ হবে। আর তারা এক বছরের মেগাবাইট ফ্রি দিতে চেয়েছে। এই সব বিবেচনায় ভালো মনে করে এটা করা হয়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি।

এ ব্যাপারে তানোর উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর রশিদ হায়দার ময়নাবলেন, তার কাছে অনেক কোম্পানির প্রতিনিধিরা ফেরিওয়ালার মতো এসেছিলেন। সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ইউএনও এর সঙ্গে আলোচনা করে তার মতামত চেয়েছিলেন। যন্ত্রটি ভালো বলে ইউএনও ও শিক্ষা কর্মকর্তা একই কোম্পানি থেকে যন্ত্রটি কেনার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন, তাই তিনিও তার মতামত দিয়েছেন। আর এই কোম্পানিই পুঠিয়া ও গোদাগাড়িতে কাজ করবে। তিনি এর বেশি কিছু জানেন না। তবে যন্ত্রটা আগের অর্থবছরে লাগানোর কথা ছিল। শিক্ষকেরা না লাগানোর কারণে ইউএনও তাদের চাপ দিচ্ছিলেন।

ইউএনও নাসরিন বানু বলেন, ‘এটা গত অর্থবছরের কাজ ছিল। কিন্তু শিক্ষকেরাই যন্ত্রটি লাগাচ্ছিলেন না। পরে মন্ত্রণালয় থেকে আবারও একটা চিঠি আসে তখন শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে সমন্বয়সভায় বসে শিক্ষকেরাই নিজেরাই নাকি ওই কোম্পানি থেকে কেনার জন্য পছন্দ করেছে এইটুকু আমার জানা আছে। ওদের সবার সম্মতি ছিল যে কেন্দ্রীয়ভাবে লাগিয়ে দিলেই ভালো হয়। দুই একজনের হয়তো ‘ইয়ে’ ছিল। তাছাড়া সবাই বলেছেন, স্যার লাগায়ে দেন আমরা টাকা পরিশোধ করে দেব।

দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার কাছে ওরা চেয়েছিলই ১৬ হাজার। দামাদামি করলে আরও তো কম হওয়ার কথা। দামের ব্যাপারে শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষকেরাই জানেন।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু ইউএনওকে ওই কমিটিতে রাখা হয়নি। সেই জন্য দামের ব্যাপারে আমি আর নাক গলাইনি। কোম্পানির ওই ছেলেটা উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গেও একটু দেখা করল।

আগাম রশিদ ও দামের ব্যাপারে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফোন দিয়ে এই বিষয়টি বলবেন বলে তিনি জানান। পরে তারা আর ফোন দেননি।

ডিজিটাল সলিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই হাজিরা যন্ত্রগুলো সরবরাহ করছে। তাদের অফিসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, রাজশাহী নগরীর আলুপট্টি মোড়। কিন্তু ঐ ঠিকানায় গিয়ে এই নামের কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।


শর্টলিংকঃ