বিদ্যুৎ খাতে আইপিপির আধিপত্য


ইউএনভি ডেস্ক:

বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ত্বরিত সমাধান হিসেবে এক সময় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বেছে নিয়েছিল সরকার। পরে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের পরিবর্তে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অগ্রাধিকার দেয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়। ফলে প্রতি বছর বিদ্যুৎ কেনার পেছনে সরকারের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এর প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে আইপিপিগুলোর পেছনে।

সরকারি, বেসরকারি, যৌথ উদ্যোগ ও আমদানি মিলিয়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতা হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। প্রতিষ্ঠানটির বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি বছরই আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিপরীতে ব্যয় বাড়ছে সরকারের। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আইপিপি থেকে ৭ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনে বিপিডিবি। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৩৪ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০ হাজার ৪১০ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৭৪৮ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হয় আইপিপিগুলোর কাছ থেকে।

সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র, আইপিপি, রেন্টাল, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আমদানি মিলিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির ব্যয় হয়েছে ৩৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকাই ব্যয় হয়েছে আইপিপিগুলোর পেছনে।

আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে তাদের প্রকল্পগুলো ফার্স্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট। উৎপাদনে এলে তাদের তো বসিয়ে রেখে টাকা দেয়া যাবে না। অন্যদিকে বিপিডিপি কিংবা অন্যান্য মেগা প্রজেক্ট চলমান। এ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে কয়েক বছরের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা কিংবা বিদ্যুৎ বিক্রয় সমান হয়ে যাবে।

আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারের ব্যয় বাড়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে কিলোওয়াটপ্রতি ক্রয়মূল্য তুলনামূলক বেশি হওয়া। বিপিডিবির বছরভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয়মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতি কিলোওয়াট ৪ টাকা ৪০ পয়সা, আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে ৫ টাকা ১১ পয়সা, রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ টাকা ৯১ পয়সা, সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে ৪ টাকা ২২ পয়সা দামে বিদ্যুৎ কিনেছে। অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়েছে ৫ টাকা ১৫ পয়সা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা, আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে ৫ টাকা ৩৬ পয়সা, রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে ৭ টাকা ৩৬ পয়সা, সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে ৩ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে ৫ টাকা ৫২ পয়সা দামে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ টাকা ৪৪ পয়সা, আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে ৫ টাকা ৭২ পয়সা, রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে ৮ টাকা ৭৭ পয়সা, সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে ৪ টাকা ৫২ পয়সা এবং ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৮৭ পয়সা ব্যয় হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতি কিলোওয়াট ৪ টাকা ৫৮ পয়সা, আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে ৭ টাকা ৪২ পয়সা, রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে ৮ টাকা ৪০ পয়সা, সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে ৩ টাকা ৮২ পয়সা এবং ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৪৬ পয়সা ব্যয় হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে ৪ টাকা ৪৭ পয়সা, আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে ৭ টাকা, রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে ৮ টাকা ৩৪ পয়সা, সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে ৩ টাকা ৮৬ পয়সা দামে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি। ওই সময় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় হয়েছে ৬ টাকা ১ পয়সা।

বিদ্যুৎ কেনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ। আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে এ সময়ে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ বেড়েছে ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ। রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে এ সময়ে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ কমেছে ৩৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমলেও ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় কম পড়বে সেখান থেকে আমরা বিদ্যুৎ নিচ্ছি। সেক্ষেত্রে কখনো সরকারি খাত, কখনো আইপিপি খাত বিবেচনা করা হয়। যেখানে খরচটাও বিবেচনায় নেয়া হয়। ফলে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ‘মেরিট অর্ডার ডেসপাচ’ খুব ভালোভাবে মেইনটেইন করা হয়। তবে আইপিপি কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়টা মূলত চাহিদার ওপর বিবেচনা করেই হয়ে থাকে।

আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে দামের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনলে যে দাম বেশি পড়বে এমনটি নয়। সরকারি কিংবা অন্যান্য উৎস থেকে কিনলেও দাম বেশি পড়তে পারে। একটা সিম্পল সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনলে দাম আইপিপির চেয়ে খুব একটা কম পড়ে না। ডিজেল, ফার্নেস অয়েল কিংবা পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রেও বেশি খরচ হয়।

প্রতি বছরই আইপিপির বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়লেও দেখা যাচ্ছে, সক্ষমতার বিচারে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে পিছিয়ে আছে আইপিপিগুলো। দেশের বিদ্যুৎ খাতের মোট স্থাপিত সক্ষমতার ভিত্তিতে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই সবার ওপরে রয়েছে। তার পরও আইপিপির ওপর নির্ভরতা বেশি বিপিডিবির।

সরকারি, বেসরকারি, যৌথ উদ্যোগ ও আমদানি মিলিয়ে এ বছরের জুন শেষে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৪৮ শতাংশ, বেসরকারি কেন্দ্রের সক্ষমতা ৪৩ শতাংশ, যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৩ শতাংশ এবং আমদানি সক্ষমতা ৬ শতাংশ। অবশ্য বেসরকারি খাতের মোট সক্ষমতার ৮৩ শতাংশই আবার আইপিপির দখলে। এ বছরের জুন শেষে আইপিপি কেন্দ্রগুলোর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াটে, যা আগের বছরে ছিল ৬ হাজার ৫০৩ মেগাওয়াট।

গত অর্থবছরে ৫ আগস্ট সবচেয়ে বেশি ১২ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নতুন করে ১ হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট সক্ষমতা যুক্ত হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ আরো ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে বিপিডিবির। এর মধ্যে ১৫ হাজার ২৯৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার ৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। ২ হাজার ৭৪৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ১২টি প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আর বর্তমানে ছয়টি প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৬ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট সক্ষমতার ২৭টি আইপিপি কেন্দ্রও রয়েছে।

আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার কারণে প্রতি বছরই বিপিডিবিকে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি বাবদ বড় অংকের অর্থ দিতে হচ্ছে। গত দুই বছরেই ভর্তুকি বাবদ বিপিডিবিকে ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ হাজার ৪৩৯ কোটি এবং আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে।

আইপিপি থেকে সরকারের বিদ্যুৎ কেনার প্রবণতা বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়া কিংবা ক্রয় করা নেতিবাচক কিছু নয়। এখন বিশ্বের মধ্যে আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সেরা উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘনাঘাট এবং হরিপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র। দেশ এ দুটি আইপিপি থেকে এখন মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ পাচ্ছে। ফলে এসব কোম্পানির সঙ্গে সরকার যদি যথাযথ দরকষাকষি করতে পারে তাহলে কম মূল্যে বিদ্যুৎ পাবে। একই সঙ্গে চুক্তি যথাযথ মেইনটেইন করতে পারলে আইপিপি বিদ্যুৎ ক্রয়ের উত্কৃষ্ট মাধ্যম হতে পারে। তবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বাইরে তেলভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যা চুক্তি অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না এবং ট্যারিফ ঠিক রাখতে পারছে না, সরকার সেগুলো ভালোভাবে তদারক করলে এখনো আইপিপি থেকে কম মূল্যে বিদ্যুৎ নেয়া সম্ভব।


শর্টলিংকঃ