মোগল ভারতে পারস্য-প্রভাব


মোগলদের রক্তে তুর্কি প্রভাব অবশ্যই আছে কিন্তু ‘মোগল’, অর্থাৎ জহির-উদ-দীন মোহাম্মদ বাবর এবং তার অধস্তন পুরুষরা মূলত তুর্ক-মোঙ্গল ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের নানা পট পরিবর্তনের কারণে মোগলদের ব্যক্তিগত জীবন, তাদের শাসন এমনকি ভারতীয় জীবনধারায় তুর্কি কিংবা মোঙ্গলীয়ের চেয়ে পারস্যের প্রভাব ছিল বেশি।

ভারতে মোগল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন পিতার দিক থেকে আমির তৈমুরের (তৈমুর লং) পঞ্চম এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের নবম অধস্তন পুরুষ। আমরা যদি বাবর বা পরবর্তী মোগল বাদশাহদের নথিপত্রের দিকে তাকাই, আমরা দেখব সেখানে তারা নিজেদের তৈমুরের উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। মোঙ্গল পরিচয় তারা কখনো পছন্দ করেননি, ফলে মোগল সংস্কৃতিতে মোঙ্গল প্রভাব ছিল সামান্যই। কিন্তু সেক্ষেত্রে তৈমুরের কারণে তুর্কি প্রভাব থাকার কথা হলেও তা পুরোপুরি থাকেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে হলে তৈমুরের মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দিকে তাকাতে হবে।

তৈমুরের মৃত্যুর পর তার অধিকৃত ভূখণ্ড ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং তৈমুরের উত্তরাধিকারীরা এসব ভূখণ্ড শাসন করার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে লড়াই চালিয়ে যান। বাবরের ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ করি, তার পিতা উমর শেখ মীর্জার মৃত্যুর পর কিছু আত্মীয় এবং অমাত্য মিলে বাবরকে উত্খাতের চেষ্টা করেন। পরবর্তী সময় সেই জ্ঞাতি-চক্রান্তেই বাবরকে সমরকন্দের পাশাপাশি পিতৃভূমি ফারগনাও হারাতে হয়। এ ‘জ্ঞাতি-সংকট’ চলাকালে যখন উজবেকরা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, তখন ফারগনা, বলখ, বদখশান প্রায় সব অঞ্চলই কোনো না কোনোভাবে পারস্যের সাহায্য কামনা করে বা পারস্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করে। সমরকন্দ হারিয়ে ‘রাজ্যহারা’ অবস্থায় বাবরও পারস্যের সহায়তা নিয়েছিলেন।

মোগল আমলের বহু আগে থেকেই ভারতে পারস্যের প্রভাব ছিল। সুলতানি আমলে সে প্রভাব ছিল মূলত ধর্ম ও দর্শনের, যা পরবর্তী সময় ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, নন্দনতত্ত্ব তথা সংস্কৃতির পাশাপাশি রাজনীতি, যুদ্ধনীতিকেও প্রভাবিত করে এবং মোগল আমলে সে প্রভাবের পরিসর বেড়েছিল। কিন্তু মোগল আমলে পারস্য কী করে এত প্রভাব ফেলেছিল তা বুঝতে, খাইবারের ওপারের রাজনীতির দিকে খানিক দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে বাবর যখন কেবল এক ভাগ্যান্বেষী, সে সময় উজবেকরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। উজবেক নেতা শায়বানি খাঁ-র হাতেই পরাজিত হয়েছিলেন বাবর। পারস্য তখন স্বাভাবিকভাবেই উজবেকদের ঠেকিয়ে রাখার চিন্তা করছিল। তৈমুরের উত্তরাধিকারীরা তখন সবাই ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত এবং দুর্বল হওয়ার কারণে উজবেকদের ওপর বিজয় লাভ করার মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে পারস্যের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল। ওদিকে উজবেকদের হাত থেকে ওই ছোট ছোট রাজ্যও মুক্তি চাইত। ফলে পারস্যের সঙ্গে তাদের একটি অলিখিত রাজনৈতিক মৈত্রী তৈরি হয়ে যায়, যার চূড়ান্ত রূপ ছিল ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে শাহ ইসমাইলের হাতে শায়বানির পরাজয়।

চতুর্দশ শতাব্দীর একদম শেষ সময়ে তৈমুর ভারতের উত্তরাংশ জয় করেছিলেন এবং এর ১২৫ বছর পর তৈমুরের উত্তরাধিকারী হিসেবে বাবর ভারতে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা করলে সে সময় তাকে সাহায্য করেছিলেন পারস্যের সাফাভিদ শাসনের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইল। বলা চলে ভারতের ওপর প্রত্যক্ষ পারস্য-প্রভাব এ সময় থেকেই শুরু হয়। কেননা বাবর যখন পারস্য থেকে ফিরলেন, তখন তিনি কিছুটা হলেও পারস্যের ভাবধারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার, বাবরের সঙ্গে পারস্যের অনেক সৈনিক এবং অভিজাত ব্যক্তিরা এসেছিলেন, যারা পরে মোগল অমাত্য হয়েছিলেন এবং তাদের বংশ পরবর্তী সময় ভারতে বিস্মৃত হয়।

মোগল শাসনের আগে ভারতে পারস্যের প্রভাব পড়েছিল মূলত ধর্মপ্রচারক এবং সুফিদের মাধ্যমে। আফগানিস্তান পেরিয়ে অনেক সাধকই ইসলামের বাণী প্রচার করতে সিন্ধু উপত্যকায় এসেছিলেন। পরবর্তী সময় তারা গঙ্গা-তীরবর্তী সমভূমিতেও পৌঁছে গিয়েছিলেন। মুসলিমরা পারস্য বিজয়ের পর সেখানে পারস্যের ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। একটা সময় ইসলামী জ্ঞান, সাহিত্য এমনকি ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ফারসি ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। ইবনে খালদুন লেখেন, ‘হাদিস সম্পর্কে যারা ব্যুত্পত্তি অর্জন করেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই পারস্যের কিংবা ফারসিভাষী ছিলেন। এছাড়া ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি শাস্ত্রের পণ্ডিতরাও পারস্যের।’ ভারতে আগত অনেক ধর্মপ্রচারক এবং সুফিরাও এ ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন।

আমরা জানি পরে ফারসি হয়েছিল মোগল দরবারের ভাষা, যেখানে বাবরের নিজের মাতৃভাষা ছিল ‘চাগতাই তুর্কি’।১ ভারতের স্থানীয় ভাষা বাদ দিলেও সহজ হিসেবে এ ভাষাই মোগল দরবারের ভাষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তুর্কি ভাষা ভারতের মানুষের কাছে পরিচিত ছিল না। সবদিক দিয়ে উপযুক্ত ভাষা ছিল ফারসি। কেননা ততদিনে একদিকে ভারতের—বিশেষত উত্তর ভারতের মানুষ ফারসির সঙ্গে পরিচিত এবং অন্যদিকে বাবরের সঙ্গী অনেক অভিজাত সরাসরি পারস্যের এবং বাকিদের কাছেও ফারসি পরিচিত।

একটি ভাষা কোনো জাতি কিংবা জনপদকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে এ প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে ইংরেজির ক্ষেত্রে। ঔপনিবেশিক আমলের আগে ঠিক এ প্রভাব ফেলেছিল ফারসি। বাবরের পর তার পুত্র হুমায়ুন যখন সিংহাসনে বসলেন, পরবর্তী সময় শের শাহর কাছে পরাজিত হয়ে তিনিও পারস্যের সহায়তা নিতে বাধ্য হন। সে সময়ে হুমায়ুন ‘তাজ’২ পরতে বাধ্য হন এবং নিজেও শিয়া মত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা পরে লাহোরে বিদ্রোহের সূচনা পর্যন্ত করেছিল। হুমায়ুনের সঙ্গেও পারস্যের সেনা, অভিজাত অমাত্য এসেছিল। পরবর্তী সময়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে পারসিকরা ছিলেন আর তাদের কারণেও ফারসি ভাষা, সাহিত্য, স্থাপত্যের বিস্তার হয়। এখানে একটি মজার ব্যাপার হলো হুমায়ুনকে বিতাড়নকারী শের শাহের বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড’ তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পারস্যের সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর করা।

মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রশংসিত সম্রাট জালাল-উদ-দীন মোহাম্মদ আকবর তার শাসনামলে ভাষা, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ধর্ম সব ক্ষেত্রেই ভারতকে কিছু না কিছু উপহার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল পারস্যের নানা কবিতা, সাহিত্য অনুবাদ করা। তিনি নিজামীর ‘খামসা’, রুমির ‘মসনবী’ থেকে শুরু করে ইমাম গাজ্জালির দর্শন অনুবাদ করিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি ভারতের ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’ প্রভৃতি সাহিত্য ফারসিতে অনুবাদের ব্যবস্থা করেন।

মোগল শাসনামলে ইসলাম প্রসারের কারণে ফারসির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং এ ভাষাতেই মুসলিমরা শিক্ষা লাভ করতে শুরু করেন এবং অমুসলিমদের মাঝেও অনেকে ফারসি জানতেন। মোহাম্মদ আবদুল গনী লেখেন, ‘ফারসি গদ্য এবং পদ্য উভয়ই মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে মুসলিম এমনকি অমুসলিম বিদ্যোৎসাহীদের কাছেও ইসলামের বাণী ও সংস্কৃতি ফারসির মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল।’

আমরা দেখি পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট থেকে শুরু করে তাদের সন্তান-সন্ততিরা ফারসি ভাষায় কাব্য, সংস্কৃতি চর্চা করেছেন। হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম, সম্রাট জাহাঙ্গীর, শাহজাদা দারা শুকোহ্, শাহজাদি জেব-উন-নিসা প্রমুখ ফারসি ভাষায় চমত্কার সব কবিতা, স্মৃতিকথা, আত্মকথা এমনকি দর্শনের বই লিখেছেন। বাবরের পর আর কাউকে সেভাবে তুর্কি ভাষার চর্চা করতে দেখা যায়নি। এমনকি বাবরের সময়েও তিনি ব্যতীত তেমন কেউ তুর্কি ভাষার চর্চা করতেন না। জাহাঙ্গীরের সময়ে এসে বলা যায় তুর্কি ভাষা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। এখানে একটি মজার এবং একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমরা যদিও মোগল বংশের শাসকদের ‘সম্রাট’ বলে থাকি, কখনো কখনো ‘রাজা’-ও হয়তো বলা হয়, কিন্তু মোগলরা নিজেদের ‘পাদশাহ’ বলতেন। শব্দটিও ফারসি।

এ ছিল মোটামুটি ভাষার কথা। এছাড়া মোগল আমলে পারস্যের সবচেয়ে বড় প্রভাব যা দেখা যায় তা ছিল চিত্রকর্মে। আমরা আজকে যাকে মোগল ‘মিনিয়েচার পেইন্টিং’ বলে জানি তা মূলত পারস্য থেকেই এসেছে। আকবর তাঁর সময়ে যে অনুবাদ করিয়েছিলেন বা তাঁর সময়ে যেসব বই লেখা হতো সেসবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিত্র সংযোজিত হতো। হুমায়ুন যখন রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের জন্য পারস্যের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তখন হেরাত হয়ে উঠেছিল শিল্পের রাজধানী। বেহজাদ নামের এক শিল্পী ছিলেন ‘মিনিয়েচার পেইন্টিং’-এর দক্ষ শিল্পী। রিচার্ড ইটন বলেন, বেহজাদের কাজ দেখে মুগ্ধ হুমায়ুন বেহজাদের কয়েকজন ছাত্রকে আমন্ত্রণ করে নিজের সঙ্গে এনেছিলেন এবং এদের হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে মোগল ভারতে চিত্রকলার এ শাখা সমৃদ্ধ হয়। মোগল আমলে লিখিত নানা বইয়ের সঙ্গে থাকা একেকটি ক্ষুদ্র-চিত্র দারুণ জীবন্ত। মোগল দরবার, অন্তঃপুর এমনকি যুদ্ধসম্পর্কিত এসব ক্ষুদ্র-চিত্রের মাধ্যমে আমরা এসব বিষয়ের বা ঘটনার একটি স্পষ্ট চিত্র দেখতে সক্ষম হই। এ ঘরানার ক্ষুদ্র-চিত্র আমরা ফেরদৌসির ‘শাহনামা’য়ও দেখতে পাই। পারস্যের এ কলা ভারতে এসে আমাদের জন্য ‘শাহনামা’র রস নিতেও সাহায্য করেছে এবং কেবল মোগল নয়, পরবর্তী সময়ে রাজপুত এমনকি মারাঠারাও ক্ষুদ্র-চিত্র গ্রহণ করে নিজেদের লিখিত ইতিহাসের সঙ্গে সেগুলো যুক্ত করেছে।

মোগল ভারতের স্থাপত্যের ওপর পারস্যের প্রভাব প্রবল। মোগল শাসনামলের প্রথমদিকে তৈরি অট্টালিকা, প্রাসাদ প্রভৃতির দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তবে তা স্পষ্ট হবে। বিশেষত ‘চারবাগ’ ঘরানার যে নকশাগুলোর ওপর ভিত্তি করে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা সরাসরি পারস্য-প্রভাবিত। এ বাগান সাফাভিদ আমলে ইস্ফাহানে দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে দিল্লি, আগ্রা থেকে শুরু করে ফতেহপুর সিক্রির বাগান এভাবেই তৈরি করা। চারবাগ মূলত কেল্লা বা দেয়ালের অভ্যন্তরে বিস্তৃত পরিসরের জায়গা নিয়ে গঠিত। মোগল আমলের এমনকি সারা বিশ্বের অন্যতম উচ্চাভিলাষী স্থাপত্য তাজমহলের বাগানটিও এ চারবাগ ঘরানার। ঢাকার লালকেল্লাও এ নকশার উদাহরণ বহন করে।

পারস্য ও মোগল স্থাপত্যের দিকে চোখ রাখলে কিছু বিষয়ে মিল দেখা যাবে। যেমন মোগল স্থাপনার দিকে তাকালে আমরা দেখব এতে বিস্তৃত খিলান রয়েছে। ভারতে তাজমহল ও ইস্ফাহানের মসজিদে একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পারস্য ও মোগল ভারতের রাজকীয় স্থাপত্যগুলোতে গম্বুজের ব্যবহার দেখা যায়, যা মূলত মুসলিম স্থাপত্যরীতির প্রভাবে হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে উভয় স্থানেই বাগান ও ফোয়ারা রাখার রীতিতে সাদৃশ্য দেখা যায়। উভয় স্থাপত্যের ক্ষেত্রেই ‘মুরাকান’৩ ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। সাধারণত খিলান ও স্তম্ভে এ নকশা ব্যবহূত হয়। দেয়ালে জাফরি কাটা নকশাও উভয় স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যদিও মোগল ভারতের স্থাপত্যে জাফরি ও ঝরোকা যুক্ত হয়ে নতুন একটি রূপ নিয়েছিল। মোগল স্থাপত্যে পারস্যের এ প্রভাব পড়ার একটি সাধারণ কারণ ‘ইসলামি স্থাপত্যরীতি’ অনুসরণ, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মোগল স্থাপত্যের নকশাকারদের অনেকেই ছিলেন পারস্যের। তাজমহলের স্থপতি ওস্তাদ আহমদ লাহোরির সহকারী হিসেবে ওস্তাদ ঈশা নামে যাকে পাওয়া যায় তিনি পারস্যের অধিবাসী ছিলেন।

ভারতে পারস্যের প্রভাবের ক্ষেত্রে ধর্ম একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। সুফি, দরবেশদের মাধ্যমে ভারতে ইসলাম প্রচার হওয়ার পর মোগলরা ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করলে পারস্য থেকে আরো ধর্মপ্রচারকরা আসেন। ভারতে তখনো চিশতিয়া তরিকা জনপ্রিয় ছিল কিন্তু মোগল শাসনের পর যদিও তা কমেনি কিন্তু বাবর নকশবন্দিয়া তরিকার ভক্ত ছিলেন। ইটন লিখেছেন, ‘বাবর একদিন নকশবন্দিয়া তরিকার সুফি শেখ ওবায়েদ উল্লাহ্ আহরারকে স্বপ্নে দেখেছিলেন যে তিনি বাবরকে সমরকন্দ আক্রমণ করতে বলছেন। এরপরই বাবুর সমরকন্দ আক্রমণ ও দখল করেন।’ যদিও সেখানে কেবল তিন মাস দশ দিনের শাসন ছিল, কিন্তু এ থেকেই বোঝা যায় শাসনক্ষমতা পাওয়ার পর কেন নকশবন্দিয়া তরিকার প্রতি তিনি উদারহস্ত হয়েছিলেন।

আকবর অবশ্য এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। যদিও তিনি চিশতিয়া তরিকার শেখ সেলিমের আশীর্বাদে সন্তান লাভ করেছিলেন, কিন্তু আমরা জানি আকবর সব ধর্মের প্রতি কৌতূহলী ও উদার ছিলেন। আকবর তার ‘ইবাদতখানা’য় যেসব ধর্ম সম্পর্কে আলোচনার জন্য পণ্ডিতদের ডেকেছিলেন, সেখানে পারস্যের পুরনো জরথুস্রীয় ধর্মও ছিল। জরথুস্রের ধর্ম বা দর্শন তথা পারস্যের পুরনো রীতির প্রভাবও মোগল ভারতে এসেছিল।

পারস্যের ও মোগল শাসকদের মধ্যে শিয়া ও সুন্নি ধারার পার্থক্য ছিল। কিন্তু ইরফান হাবিব বলেন, ‘এ পার্থক্য কখনই দুই অংশের মধ্যকার বৌদ্ধিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি; অবশ্য এজন্য মোগল শাসনের সহিষ্ণু মনোভাবকে কৃতিত্ব দিতে হয়।’

ভাষা, স্থাপত্য, ধর্মের পাশাপাশি আরো দুই ক্ষেত্রে মোগল ভারতে পারস্যের প্রভাব ছিল—রাজনীতি ও যুদ্ধনীতিতে। বাবর যখন কাবুলে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন তখন তার সঙ্গে উজবেক কর্তৃক বিতাড়িত তৈমুর বংশের পুরুষেরা ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা মোগল ভারতে বিকশিত হননি, যা পারস্য থেকে আগতরা হয়েছিলেন। বাবরের শাসনামলে না হলেও পরবর্তী সময়ে পারস্য বংশোদ্ভূত অনেক অভিজাত ব্যক্তি মোগল ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিলেন। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে বল যায় বাবরের দিল্লি জয়ের নেপথ্যে একদিকে যেমন ছিল তুর্কি বন্দুক, অন্যদিকে পারস্যের সৈন্য সরাসরি যুদ্ধ করেছিল বাবর ও হুমায়ুনের বাহিনীতে। মোগল যুদ্ধনীতি পরবর্তী সময়ে পারস্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এমনকি আকবর তার কর্মচারীদের নাসির-উদ-দীন তুসির ‘আখলাক-ই-নাসিরি’ পড়ার পরামর্শ দিতেন, যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও উপদেশ ছিল।

আকবরের সময় পর্যন্ত মোগল ভারত বলতে যে ভৌগোলিক সীমা ছিল তা মূলত ‘উত্তর ভারত’। আকবরের শাসনামলের শেষে দাক্ষিণাত্য কিছুটা হলেও মোগল শাসনের অধীনে আসে। আওরঙ্গজেব তার অর্ধেক জীবন ওই দাক্ষিণাত্যকে বশ করতে কাটিয়েছেন। মজার ব্যাপার দাক্ষিণাত্য মোগল শাসনের অধীনে আসার আগেই সেখানে ফারসি ভাষা, সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। বিজাপুর ও গোলকোন্ডার দুই মুসলিম রাজ্যের সঙ্গে পারস্যের যোগাযোগ ছিল। এদের সামরিক শিক্ষাও অনেক ক্ষেত্রে পারস্য প্রভাবিত। ‘কুতুবশাহি’ এবং ‘নিজামশাহি’র সঙ্গে পারস্যের এ সম্পর্কের কারণ প্রথমত পারস্যের যুদ্ধনীতি শেখায় তাদের আগ্রহ এবং শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে সংযোগটা সহজ হয়েছিল। অর্থাৎ, বৃহত্তর ভারতের সর্বত্র পারস্যের প্রভাব ছিল এবং বাংলাও এ প্রভাবের বাইরে ছিল না। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের বাংলা অভিযানের আগেই বাংলায়ও ফারসির প্রভাব ছিল, যা ইংরেজ আমলেও নিজের প্রভাবের প্রমাণ রেখেছিল।

তবে পারস্যের বা পারস্য বংশোদ্ভূত অভিজাত ব্যক্তিদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত আওরঙ্গজেবের সময় এবং তার পরে। অবশ্য এর আগেই আকবরের সময় থেকেই তারা নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। নূর জাহানের পিতা গিয়াস বেগ পারস্য থেকে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘ইতিমাদ-উদ-দৌলা’ তথা ‘সাম্রাজ্যের স্তম্ভ’ উপাধি পেয়েছিলেন এবং জাহাঙ্গীরের সময়ে তারই পুত্র আসফ খাঁ ছিলেন অন্যতম প্রধান সেনাপতি। বলাবাহুল্য নূর জাহানের মাধ্যমে মোগল অন্তঃপুরে পারস্যের সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়েছিল। আরেকটি ব্যাপার হলো, মোগল সম্রাটরা পারস্যের অভিজাত বংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। আকবর নিজেও পারস্য রক্তের অধিকারী, কেননা তার মা হামিদা বানু বেগমের পিতাও পারস্যের অধিবাসী ছিলেন। হুমায়ুনের পরেও প্রায় সব বাদশাহ এবং শাহজাদাদের সঙ্গে পারস্য বংশের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়েছিল।

মোগল রাজবংশে মোগল-পারসিক মিশ্র রক্তের প্রজন্মের বাইরে অমাত্যদের বংশ বৃদ্ধি হয় এবং তারা মোগল দরবারে একটি বিশেষ জায়গা তৈরি করে নেন। পারস্য বংশোদ্ভূত এ রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের শক্তি বৃদ্ধি হয়ে আওরঙ্গজেবের সময় থেকেই মোগল দরবারে দুটি শ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের একটি পারস্য বংশোদ্ভূত অমাত্যদের এবং অন্যটি দেশীয় অমাত্যদের। নূর জাহানের সঙ্গে শাহজাহানের দ্বন্দ্ব উপস্থিত না হলে আরো আগেই মোগল দরবার পারস্যের অমাত্যদের হাতে থাকত, কিন্তু তা হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছিল। আওরঙ্গজেবের সময়ে তিনি নিজ গুণে দরবারে ভারসাম্য রেখেছিলেন কিন্তু এরপর তা সম্ভব হয়নি।

আজকে আমরা যাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বলি, সে এ রকম জটিলতা তৈরি হয়েছিল আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে অন্তঃকোন্দলের কারণে নিশাপুরের রক্ত প্রবাহিত চেন কালিজ খান মোগল দরবার থেকে বিতাড়িত হয়ে পরবর্তী সময়ে প্রথমে হায়দরাবাদে ‘নির্বাসিত’ এবং পরে কার্যত স্বাধীন রাজ্য ‘আসফ শাহি’ প্রতিষ্ঠা করে প্রথম ‘নিযাম’৪ হয়েছিলেন। রাজনীতি এবং আমলাতান্ত্রিক এ জটিলতাকে সরাসরি ‘পারস্যের প্রভাব’ মনে না হলেও মূলত একদিন যে পারস্য শক্তির সাহায্যে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়াই ছিল। অবশ্য ‘ইরানি-তুরানি’ এ জোটের কারণেই মোগল বংশ ভারতের মাটিতে আরো কিছুদিন টিকে ছিল। যেমন মোগল শাসনের দৃঢ়তা এবং মোগল বংশকে সংহত রাখতে চেন কালিজ খান সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন।

আওরঙ্গজেব নিজে পারস্য বংশোদ্ভূত অমাত্যদের বিশ্বাস করতেন। হামিদ-উদ-দীনের ‘আহকাম-ই-আলমগিরি’ অনুসারে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন, ‘এদের দক্ষতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যুদ্ধে তারা সব সময় সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের পাশে ছিলেন। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করা এদের স্বভাব নয়।’ এতকিছুর পরও আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে হিন্দুদের নিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন। অড্রে ট্রুশকের মতো ইতিহাসবিদরা এ উদাহরণ টেনে আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা প্রমাণ করতে চান কিন্তু মূলত দক্ষ রাজনীতিবিদ আওরঙ্গজেব বুঝেছিলেন মোগল শাসনে পারস্য বংশোদ্ভূত এ অমাত্যদের প্রভাব বাড়ছে, যা মোগল বংশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দেশীয় ও হিন্দুদের নিয়োগ বাড়ানোর নেপথ্য কারণ ছিল পারস্যের প্রভাব কমিয়ে সাম্যাবস্থা বজায় রাখা।

অর্থাৎ মোগল শাসনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পারস্যের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ ও প্রবল। ভাষা থেকে শুরু করে ধর্ম, স্থাপত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রে আজও পারস্যের প্রভাব রয়েছে। যেমন আজ যে জালালুদ্দিন রুমি এত জনপ্রিয়, আকবর তার সময়েই সভাসদদের ‘মসনবী’ পড়ার পরামর্শ দিতেন। ভারতের হেন ভাষা বা সংস্কৃতি নেই যেখানে ‘লাইলি-মজনু’ নেই অথচ লাইলি-মজনুর এ গল্পও পারস্য থেকেই এসেছে। মোগল আমলের আগে আমির খুসরো এবং পরবর্তী সময়ে মীর ত্বকি, দাগ দেহলবি থেকে শুরু করে উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি গালিবের কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে ফারসি ভাষার কারণে। উর্দু ভাষায় বলিষ্ঠতা, কোমলতা, গাম্ভীর্য এনেছে ফারসি। এমনকি আজ যে হিন্দি ব্যবহূত হয় তাতেও ফারসির প্রভাব বিদ্যমান। মোগল ভারতে পারস্য প্রভাবে সাহিত্য থেকে শুরু করে মিনিয়েচার পেইন্টিং, ক্যালিগ্রাফি, স্থাপত্যে চারবাগ থেকে শুরু করে হিন্দি, উর্দু এমনকি বাংলা সাহিত্য এবং শব্দভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়েছে।

 

টীকা

১. বাবর এই ভাষাতেই তার রোজনামচা লিখেছেন, যা আজ ‘বাবরনামা’ বলে পরিচিত।

২. ১২ ইমামের নাম লেখা এক ধরনের পাগড়ি, যা শিয়ারা ব্যবহার করে।

৩. কিছু গলে বা চুইয়ে পড়ছে এমন নকশা।

৪. চেন কালিজ খানের মূল নাম মীর কামারুদ্দীন সিদ্দিকী, যিনি তার কর্মের জন্য মোগল দরবার থেকে ‘নিজাম’ উপাধি লাভ করেন। পরে হায়দরাবাদে তার প্রতিষ্ঠিত কার্যত স্বাধীন রাজ্যে তার উত্তরাধিকারীরা ‘নিজাম’ নামে পরিচিত হন।

 

তথ্যসূত্র

1. Eaton, R. M. (2019). India in the persianate age: 1000-1765, Penguin

2. Ghani, M. A. (1983). A History of Persian Language and Literature at the Mughal Court (Vol. ii). Lahore: Hijra International Publishers.

3. Habib, I. (Ed.). (2002). A Shared Heritage: The Growth of Civilizations in India & Iran. New Delhi: Aligarh Historians Society, Tulika Books.

4. Hamid-ud-Din. (1912). Ahkam-i- Alamgiri. (J. N. Sarkar, Ed., & J. N. Sarkar, Trans.)

5. মোগলনামা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড): মাহমুদুর রহমান, আহমদ পাবলিশিং হাউজ।

 

মাহমুদুর রহমান: লেখক


শর্টলিংকঃ