রাণীনগরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ


রাজেকুল ইসলাম, রাণীনগর (নওগাঁ):

নওগাঁর রাণীনগরে নদী-নালা খাল-বিলে ঢলের পানি কমার সাথে সাথে দেশি প্রজাতিসহ অন্যান্য জাতের মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর এই সময় স্থানীয় মৎস্যজীবিরা নদী বিলে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত সময় পার করলেও এবছর আশানুরুপ মাছ ধরতে না পারায় তারা অলস সময় কাটাচ্ছে।

পরিবার পরিজন ও মহাজনের ঋনের বোঝা সামাল দিতে অনেকে এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। সকাল বিকাল হাটবাজারে আড়ৎদারদের মাছ কেনা বেচার হাঁক ডাকে মুখরিত সেই সব আড়ৎদার পট্টিতে এখন দেশী প্রজাতির মাছ শূন্য।

সকালে অল্প সময়ের জন্য কিছু মাছের আমদানী হলেও পর্যাপ্ত মাছ আমদানী না হওয়া মহাজনেরা আড়ৎ বন্ধ করে তারাতারি বাড়ি চলে যাচ্ছে। ফলে তাদের মাঠ পর্যায়ের দাদনের টাকা তুলতেও হিমশিম খাচ্ছে। মাছ ধরার আশায় নদী-নালা, খাল-বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় গুলোতে বিভিন্ন ধরণের জাল দিয়ে মাছ ধরতে কেটে যাচ্ছে মৎস্যজীবিদের সারা দিন।

তবুও মিলছেনা মাছ বিক্রি করে শ্রমের মজুরী। তবে উপজেলা মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে দেশীয় জাতের মা মাছ রক্ষার্থে মৎস্যজীবিদের সচেতন করা ও খাল-বিলে সব ধরণের মাছ সারা বছর চাহিদা মত রাখতে নজরদারীর পাশাপাশি অসাধু মৎস্যজীবিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২ টি অভয়াশ্রম করা হয়েছে।

নওগাঁ জেলা থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে খাল-বিল, নদী বেষ্টিত উপজেলা রাণীনগর। এই উপজেলার পশ্চিমে কাশিমপুর, মিরাট ও গোনা ইউনিয়নের কোল ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে নওগাঁর ছোট যমুনা নদী। মিরাট ইউনিয়নে রয়েছে উন্মুক্ত জলাশয় বিল চৌর ও বিল মুনছুর।

সদর ইউনিয়ন ও পারইল ইউনিয়নে রয়েছে রক্তদহ বিল। বছরের এই সময় বৈরি আবহাওয়ার কারণে লাগাতার বৃষ্টিপাতে উপজেলার বিভিন্ন ছোট বড় নদ-নদী খাল বিল পানিতে ডুবে যায়। বর্তমানে তীব্র তাবদাহে পানি কমতে থাকলেও ধরা পড়ছে না দেশীয় জাতের মাছ।

বুধবার উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা, ধনপাড়া, মিরাট, বৈঠাখালি, ও গোনা ইউনিয়নের ঘোষগ্রাম, পিরেরা, বেতগাড়ী, দুর্গাপুর ও কাশিমপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মৎস্যজীবিরা মাছ সংকটের কারণে হাতে তেমন কাজ না থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

অথচ এই সময় মৎস্যজীবিরা নদী, খাল বিলে জাল দিয়ে মাছ ধরে প্রতিদিন ৫শ থেকে ৮শ টাকা পর্যন্ত আয় করার কথা থাকলেও মাছের আকালের কারণে উপযুক্ত শ্রম দিয়েও আশানূরুপ মাছ না পেয়ে অভাব অনটনের সময়ে পরিবারের সদস্যদের ডাল ভাত যোগাতে তারা মহাজনের ঋনের বেড়া জালে পড়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, এই অঞ্চলে এবার নদ-নদী খাল বিলে দেশীয় জাতের মাছ যেমন পুঁটি, টেংড়া গচি, চিংড়ি, শাটি, মলা, ঢেলা, চান্দা, বোয়াল, পাতাশি, রাইকর, স্বরপুঁটি, কই, শিং, মাগুড়, বোয়ালসহ বিভিন্ন জাতের দেশী প্রজাতির মাছের আমদানি কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলের হাট বাজারগুলোতে এই প্রজাতির মাছ আগের মতো আমদানি একেবারে নেই বললেই চলে।

অল্প কিছু মাছ আমদানি হলেও তা আবার চলে যায় বৃত্তবানদের হাতে। সাধারণ মানুষের কপালে জোটেনা দেশী প্রজাতির সু-স্বাদু এই মাছগুলো।

উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে মৎস্যজীবির সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৭ শ’ জন, রেজিঃ ধারী মৎস্যজীবির সংখ্যা ১৭ শ’ ৬৪ জন। মৎস্য চাষীর সংখ্যা ৪ হাজার ৯ শ’ জন। মৎস্যজীবি সমিতির সংখ্যা ৬০টি।

রাণীনগরে বার্ষিক মাছের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন। পুকুর ও দীঘির সংখ্যা ৪৮৪টি, মৌসুমী জলাশয়ের সংখ্যা ৩১০টি, নদীর সংখ্যা ৫টি, বিলের সংখ্যা ৬টি, প্লাবন ভূমির সংখ্যা ১৬টি, বানিজ্যিক মৎস্য খামারের সংখ্যা ৩১টি, মৎস্য অভয়াশ্রম ২ টিসহ বিভিন্ন ধরণের জলাশয়ে মৎস্যজীবিরা মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে।

উপজেলার কুজাইল বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান তোতা জানান, বর্তমানে কুজাইল বাজারে আগের তুলনায় দেশী মাছ আমদানি অনেক কমে গেছে। নদী-নালা খাল-বিলে পানি কম থাকায় মৎস্যজীবিরা পরিমাণ মতো মাছ ধরতে পারছে না। তাই এই মোকামসহ আশে পাশের মোকামগুলোতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে।

রাণীনগর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. মাকছুদুর রহমান বলেন, মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে দেশীয় জাতের মা মাছ রক্ষার্থে মৎস্যজীবিদের সচেতন করা ও খাল-বিলে সব ধরণের মাছ সারা বছর চাহিদা মত রাখতে নজরদারীর পাশাপাশি অসাধু মৎস্যজীবিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২ টি অভয়াশ্রম করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায়, জলাশয়গুলো দিনদিন ভরাট করা, জমিতে অতি মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগসহ নির্বিচারে মৎস্য নিধনের কারণে উন্মুক্ত জলাশয়ে জন্ম নেওয়া দেশী প্রজাতি মাছগুলো কমে যাচ্ছে।


শর্টলিংকঃ