শোকাশ্রুতে লেখা যাদের নাম


আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী:

আমার লন্ডনের বাসার কাছে হাইগেটে কাল মার্কস-এর সমাধি। আমি মাঝে মাঝে হাইগেটে গেলে মার্কসের সমাধিতে যাই। বিশ-পঁচিশ জন লোক রোজই ওই সমাধিতে আসেন। কেউ ফুল দেন। কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে শ্রদ্ধা জানান। এরা সবাই যে কমিউনিস্ট তা নয়। অনেকে মার্কসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের কথাও জানেন না। শুধু জানেন, মার্কস একজন মহামানব ছিলেন। কট্টর কমিউনিস্টরাও এই সমাধিতে আসেন। একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ক্রুশ্চেভ সাহেবও এই সমাধিতে ফুল দিতে এসেছিলেন।

একবার এক আইরিশ তরুণীকে মার্কস-এর সমাধিতে ফুল দিতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কি কমিউনিস্ট? তিনি বললেন, না। জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে এই সমাধিতে ফুল দিতে এসেছেন কেন? মহিলা বললেন, এই মানুষটির কথা জানি। তার সাম্যবাদী বিপ্লবের জন্যই আজ আমরা ব্রিটেনেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান- সব ব্যাপারে সরকারি সাহায্য পাচ্ছি। নইলে আঠারো শতকে ব্রিটেন বিরাট সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থাকা সত্ত্বেও ব্রিটেনের মানুষকে কি অমানবিক জীবনযাপন করতে হতো তা জানেন না।

কয়েক বছর আগে ঢাকার জাতীয় শহীদ মিনার দেখতে গিয়েছিলাম। বিজয় দিবস তখন আসন্ন। তাই জাতীয় সৌধ ধুয়ে-মুছে সাফ করা হয়েছে। একদল কলেজপড়ুয়া ছাত্রী স্মৃতিসৌধের চত্বরে বসে গল্প করছেন। লন্ডনে কার্ল মার্কসের সমাধিতে দেখা আইরিশ মহিলার কথা মনে পড়ল। তিনিও আরও কয়েকজন মহিলার সঙ্গে ছিলেন। মার্কসের সমাধিতে শুধু মার্কস নন, তার স্ত্রী ও কয়েকজন সন্তানও সমাহিত আছেন। এই সমাধির মাথার কাছে মার্কসের ভাস্কর্য। ঢাকায় যেমন উগ্র ইসলামপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার চেষ্টা করছে, লন্ডনেও অতীতে তেমনি মার্কসের ভাস্কর্য ভাঙার চেষ্টা নিয়মিত হতো। এখন অবশ্য তা বন্ধ হয়েছে।

মার্কসের সমাধিতে দেখা আইরিশ মহিলার কথা মনে হতেই ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আগত তরুণীদের কারও সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল। তাদের একজনকে বেছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা কেন এখানে এসেছেন? তরুণী সবিনয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা আমাদের বিজয়ের মাস। তাই শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিতে এসেছি। বললাম, এদের কারও সম্পর্কে কিছু জানেন? তরুণী বললেন, জানি না। শুধু এইটুকু জানি, তারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তার পরই আমার দিকে চেয়ে তরুণী বললেন, আপনি কাউকে চেনেন? বললাম প্রত্যেককে চিনি। মুনীর চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাসা থেকে তুলে তাকে আরও অনেকের সঙ্গে বধ্যভূমিতে নেয়া হয়। তারপর নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

একইভাবে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ, গোবিন্দ দেব, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দীন আহমদ এবং আরও অনেকের কথা বললাম। তরুণীরা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তাদের কাছে বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বি এবং চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলিমের কথা বললাম। ডা. রাব্বিকে হত্যা করে তার হার্ট খুবলে নেয়া হয়েছিল। আর ডা. আলিম চৌধুরীর চোখ তুলে নেয়ার পর হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল তারা ছিলেন স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবী। তাদের হত্যা করে পাকিস্তানের শাসকরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে এমনভাবে মেধাশূন্য করতে, যাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য কোনো বুদ্ধিজীবী, কোনো মেধাসম্পন্ন লোক বেঁচে না থাকে।

এই তরুণীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ জন্মগ্রহণ করেননি। এই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কথা জানলেও দেশে ’৭১ সালে যেসব বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানেন না। আর জানবেন কী করে? দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ এবং জিয়াপন্থী খালেদার আমলে দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম, এমনকি বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানাও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসা এবং তিন দফা একটানা ক্ষমতায় থাকতে পারার দরুন বঙ্গবন্ধু জাতির পিতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উন্নতি করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে গণহত্যা সম্পর্কিত জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা কার্য চলছে। বিভিন্ন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে ফাউন্ডেশন হচ্ছে। তবু দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত পরিচয়, তাদের আদর্শ ও ত্যাগের কথা যে তুলে ধরা গেছে তা নয়। বাংলাদেশে সাধারণভবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস দুটি। একটি ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের বুদ্ধিজীবী নিধন। এই সময় অধ্যাপক অজিত গুহ, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক গোবিন্দ দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় দফা ১৪ ডিসেম্বর তারিখে (বিজয় দিবসের দু’দিন আগে) মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেককে হত্যা করা হয়। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনও এদের সঙ্গে ছিলেন। মহিলা বুদ্ধিজীবীরাও এই শহীদের তালিকায় আছেন। তাদের একজন ছিলেন সাপ্তাহিক ললনার সম্পাদক। অন্যজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণী কবি।

আরও অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী আছেন। যাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। নোয়াখালী, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহীতে স্থানীয় অনেক লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিককে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের সহযোগী জামায়াতি রাজাকার-আলবদরদের সাহায্যে হত্যা করেছে। প্রত্যেক জেলাতেই এদের নাম আলাদাভাবে সংগ্রহ করে আলাদাভাবে তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হওয়া উচিত।

প্রথম মহাযুদ্ধে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেসব সৈন্য নিহত হয়েছেন, তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য জাদুঘর ছাড়াও বহু স্মৃতিস্তম্ভ আছে লন্ডনসহ বহু শহরে। যেসব নিহত সৈন্যের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, তাদের জন্য অজ্ঞাতনামা সৈন্যদের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে। রানী এলিজাবেথও এই অজ্ঞাতনামাদের স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে প্রতি বছর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আমরাও দেশের অজ্ঞাতনামা শহীদদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে পারি। প্রতি বছর এই স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে অজ্ঞাতনামা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী, যাদের স্মরণে ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে, তাদের কথায় ফিরে আসি। আজ ১৪ ডিসেম্বর তাদের ৪৯তম শাহাদতবার্ষিকী। ডিসেম্বর আমাদের ক্ষোভের মাস এবং আনন্দের মাস। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে ‘পৌষ ফাগুনের খেলার’ কথা, ডিসেম্বর আমাদের জীবনে যে রকম পৌষ ফাগুনের খেলা, আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শোকার্তচিত্তে স্মরণ করি। দু’দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দে মুখরিত হই।

স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। জাতির পিতার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। তাদের কেউ ছিলেন খ্যাতনামা শিক্ষক, কেউ ছিলেন নামকরা সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার। আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিতে তাদের অবদান অতুলনীয়। এ অবস্থায় তাদের প্রত্যেকের জীবন ও কর্মের কথা প্রাথমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।

ইংরেজ আমলেও আমরা ক্লাস ফোরে পড়ার সময় পাঠ্যবইয়ে বীর আশানন্দ ঢেঁকীর জীবনী পড়েছি। এখন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, যাদের জীবন ও কর্ম উৎসর্গিত হয়েছে দেশের মানুষের কল্যাণে, তাদের কথা আমাদের নবপ্রজšে§র কাছে তুলে ধরার শ্রেষ্ঠ উপায় পাঠ্যপুস্তকে তাদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি।

লক্ষ রাখতে হবে, এই জীবনী যেন সঠিক জীবনী হয়। এজন্য উপযুক্ত লেখক বাছাই করা দরকার, যারা এই শহীদদের জীবন ও কর্ম সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য পরিশ্রম করে, গবেষণা করে তথ্য সংগ্রহ করবেন এবং তা লিপিবদ্ধ করবেন।

আজ চৌদ্দ ডিসেম্বরে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করি। সেই সঙ্গে জাতির পিতা, জাতীয় নেতাসহ সব মুক্তিযোদ্ধা শহীদের প্রতিও জানাই শ্রদ্ধা। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।

লন্ডন, ১৩ ডিসেম্বর, রবিবার, ২০২০


শর্টলিংকঃ