স্বর্ণ বাণিজ্য, আফ্রিকা ও মানসা মুসা


গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে পৃথিবীর বয়স যখন ১০০০ খ্রিস্টাব্দ ছুঁয়েছিল, তখন সারা দুনিয়া প্রথমবারের মতো বাণিজ্য সংযোগে যুক্ত হয়েছে। এতে আফ্রিকার মানুষের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অনেক ইতিহাসবিদ এক্ষেত্রে আরবদের বড় কৃতিত্ব দিলেও আফ্রিকার মানুষের ভূমিকাকে আমলে নেননি। আধুনিক সময়ে এসে এক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে। আরবের ইসলামী দুনিয়া ও অফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্য সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আফ্রিকানদের। ১৪৯২ সালের আগে ইউরোপ ও এশিয়ায় যে পরিমাণ স্বর্ণ প্রবেশ করত তার দুই-তৃতীয়াংশের জোগান আসত পশ্চিম আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকা থেকে প্রচুর দাসের সরবরাহ ছিল ইসলামী দুনিয়ায়।

পশ্চিম আফ্রিকায় সেকালে মুসলমানদের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিবরণী পাওয়া যায় কর্ডোবার একজন ইসলামী পণ্ডিতের মাধ্যমে, অবশ্য তিনি কখনো আফ্রিকা ভ্রমণ করেননি। তার নাম আল-বাকরি। আফ্রিকা থেকে ফেরা পর্যটক ও বণিকদের বিবরণী, সাক্ষী তিনি সংকলন করেছিলেন। আল-বাকরি ঘানার একজন রাজার কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেটা ছিল বাকরি তার সংকলগ্রন্থ সমাপ্ত করার পাঁচ বছর আগে। ঘানার এ রাজার এত স্বর্ণ ছিল যে আল-বাকরি লেখায় অনেকটা জায়গা তার জন্য বরাদ্দ করেছেন। এ রাজার ছিল স্বর্ণ দিয়ে সাজানো মুকুট ও স্বর্ণের ঢাল-তলোয়ার। তার দরবারের তরুণ অভিজাতদের চুলে থাকত স্বর্ণের বিনুনি। রাজার ঘোড়াদের পিঠে থাকতে স্বর্ণের সাজ, কুকুরের গলায় স্বর্ণের কলার। শুনতে বেশ অকল্পনীয় মনে হলেও এসবই সত্য। এ রাজা স্বর্ণের উৎপাদনে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। প্রজাদের অনুমতি ছিল স্বর্ণরেণু আহরণের কিন্তু স্বর্ণের খণ্ড কেবল রাজার অধিকারে। তার কাছে বড় বড় পাথরের টুকরোর মতো স্বর্ণখণ্ড ছিল।

ট্রান্স-সাহারান স্বর্ণ বাণিজ্য চূড়া স্পর্শ করে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। কারণ ছিল এ সময় ইউরোপে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যায় বিপুলভাবে। সে সময় প্রতি বছর সাহারা অঞ্চল দিয়ে ইউরোপে যেত তিন থেকে চার টন স্বর্ণ। যার মূল্য এখনকার হিসেবে ১৫ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। আর এ স্বর্ণ বাণিজ্যের চূড়ায় ছিলেন যে ব্যক্তি তিনি মানসা মুসা। চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ২৫ বছর তিনি মালি সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তার সম্পদ মানুষকে চমকে দিয়েছিল। তার একার দান-খয়রাতে কায়রোতে স্বর্ণের দাম পড়ে গিয়েছিল। মক্কায় হজপালন করতে যাওয়ার পথে তিনি কিছুদিন কায়রোতে ছিলেন। কায়রোতে দুজন মানুষের সঙ্গে মুসা স্বর্ণের বাণিজ্য নিয়ে আলাপ করেছিলেন। তাদের একজন ছিলেন আল-দুক্কালি। এই দুক্কালি একসময় মালিতেই বাস করতেন। অরেকজন ছিলেন আল-জাওয়ায়ি। তিনিও মুসার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন তার সাম্রাজ্যের স্বর্ণ বাণিজ্যের মূল নকশাটি বুঝতে। এ আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে আল-জাওয়ায়ি জানিয়েছেন, মুসার সাম্রাজ্যে খনি থেকে স্বর্ণ আহরণের কাজ করত মূলত অমুসলিমরা। স্বর্ণ সংগ্রহের জন্য খনিতে একজন মানুষের সমান দৈর্ঘ্যের গর্ত করা হতো। গর্তের দেয়াল বা তলায় স্বর্ণ পাওয়া যেত। আহরিত স্বর্ণের একটি অংশ দেয়া হতো শ্রমিকদের। আল-জাওয়ায়ি আরো জানিয়েছেন, নিজের সাম্রাজ্যে উৎপাদিত তামা রফতানি করে মুসা স্বর্ণ আমদানি করতেন। অফ্রিকার আরেকটি অঞ্চল থেকে ১০০ একক তামার বদলে ৬৬ একক স্বর্ণ আমদানি করতেন মুসা।

মানসা মুসা মারা যান ১৩৩৭ সালে। সে সময় ইউরোপে স্বর্ণের চাহিদা পড়ে যায়নি। কিন্তু ১৩৪৭-৪৮ সালের প্লেগ মহামারীতে ইউরোপ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় স্বর্ণের চাহিদা কমে আসে। কিন্তু সেই শতাব্দীতে মুসার ধনসম্পদের কথা মানুষ ভোলেনি। তাই দেখা যায় ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে ইহুদি মানচিত্রকর আব্রাহাম ক্রেসকাস তার তৈরি করা পশ্চিম আফ্রিকার মানচিত্রে মানসা মুসার প্রতিকৃতি যুক্ত করেন। তখন পর্যন্ত এ ক্যাটালান অ্যাটলাসই ছিল আফ্রো-ইউরেশিয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানচিত্র।

 

স্বর্ণ যেন মানসা মুসার জীবনের সঙ্গে শুরু থেকেই জড়িয়ে আছে। ইবনে বতুতা যখন মালি সফর করেন, তখন তিনি সেখানে একটি কিংবদন্তি শুনেছিলেন। মানসা মুসা তখন বালক। কোনো ক্ষমতাও নেই তার। একদিন এক ব্যক্তি তাকে সাত মিসকাল স্বর্ণ দেন। মুসা সম্রাট হওয়ার পর একটি বিচারের জন্য তিনি দরবারে আসেন এবং মুসা তাকে চিনে ফেলেন। তিনি সেই ব্যক্তিকে তার সিংহাসনের পাশের একটি আসনে বসান। বহু বছর আগে তিনি মুসার প্রতি যে দয়া দেখিয়েছিলেন, তার জন্য মুসা তাকে কৃতজ্ঞতা জানান। এরপর তিনি তার সেনাপতিদের প্রশ্ন করেন কীভাবে সেই ব্যক্তির কাজকে পুরস্কৃত করা উচিত। তারা পরামর্শ দেন শাসকের উচিত মূলের ১০ গুণ ফেরত দেয়া। কিন্তু মানসা মুসার কাছে তা যথেষ্ট মনে হয়নি। তিনি সেই ব্যক্তিকে ৭০০ মিসকাল স্বর্ণ দেন। সঙ্গে দেন সম্মানসূচক আলখাল্লা এবং এক জোড়া নারী ও পুরুষ দাস।

অফ্রিকার তীব্র গরমের কারণে শরীর থেকে যে ঘাম বের হয়ে যেত, তাতে থাকত লবণ। শরীরে এ লবণের ঘাটতি মেটাতে সুদানের মানুষের জন্য লবণ ছিল খুবই জরুরি পণ্য। আর মানসা মুসার কাছে ছিল লবণেরও একচেটিয়া অধিকার। সুদানের মানুষ লবণের সঙ্গে সমপরিমাণ স্বর্ণের বিনিময় করতেন।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে স্বর্ণের চাহিদা আবার বাড়তে থাকে। তবে এবার আফ্রিকার একচেটিয়া স্বর্ণ বাণিজ্যে হাজির হয় নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রিন্স হেনরি দ্য নেভিগেটরের নেতৃত্বে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে পর্তুগিজরা পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে পা রাখে। এ শতাব্দীর মাঝামাঝি তারা আফ্রিকার স্বর্ণ ও দাস বাণিজ্যের অনেকটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এ বাণিজ্যের জন্য তাদের নতুন কোনো কাঠামো তৈরি করতে হয়নি। উৎপাদন থেকে বিপণন—সবখানেই মানসা মুসার আমল থেকেই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছিল। তারা পশ্চিম আফ্রিকার স্বর্ণখনিগুলোর দখল নিয়ে নেয়। ১৪৮২ সালে পর্তুগিজরা ঘানায় এল মিনায় একটি বাণিজ্য দুর্গ স্থাপন করে। এলাকাটিতে তখনকার দিনের অন্যতম বড় স্বর্ণের খনি ছিল। সে সময় বছরে পর্তুগিজরা ৭০০ কেজি স্বর্ণ আফ্রিকা থেকে লিবসনে নিয়ে যেত।

শোনা যায় মানসা মুসা ইউরোপীয় কাপড়ে তৈরি আলখাল্লা পরতেন। তার পায়জামা ছিল ২০ টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরি। এমন পোশাক মালিতে আর কেউ পরতেন না। যখন তার প্রেরণ করা কোনো অভিযাত্রী অভিযান শেষে ফিরতেন, তখন মুসা তাকে বেশ ঢিলেঢালা পায়জামা উপহার দিতেন। মুসার সবসময় মাথায় পাগড়ি পরতেন।

মুসার নিজের হারেম ছিল, যেখানে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সুন্দরীদের দেখা যেত। তার প্রধান স্ত্রীর নাম ছিল ইনারি কুনাতে। এই স্ত্রী মক্কায় হজযাত্রায় মুসার সঙ্গে ছিলেন।

মালিতে তখনো সম্রাট মৌখিক আদেশেই শাসন করতেন। তবে মুসার নিজস্ব লিপিকার ছিল। তারা সম্রাটের বিভিন্ন বার্তা লিখতেন। এগুলো মূলত ব্যবহার করা হতো মালির বাইরের শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে। যেমন একবার মুসা তার এক লিপিকারের লেখা একটি বই পাঠিয়েছিলেন মিসরের সুলতানকে।

 

এসএম রশিদ: লেখক


শর্টলিংকঃ