হলি আর্টিজান রায়ঃ আইনের সুশাসনে অনন্য বাংলাদেশ


২০১৬ সালের জুলায়ের ১ তারিখ। অন্যান্য দিনগুলোর মত একটি সাধারণ দিন ছিল। পাখি ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য যাত্রা শুরু করে ঢাকার মানুষ। সারাদিন কর্মব্যস্ততা নিয়ে বাসায় ফেরার সময় মোবাইল স্ক্রিনে আর টিভির ফ্রেমে চোখ আটকে যায় সবার। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা। হামলার খবরে স্তম্ভিত করে গোটা জাতীকে।

সরকারের দ্রুত প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত এক বছরে রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় ১১৩ জন সাক্ষী হাজির করে। যা ছিলো অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া। এর আগে হামলার ব্যাপারে জড়িতদের গ্রেফতারী কার্যক্রম ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিলো।

এ হামলা নিয়ে অভিযোগপত্রে সে রাতের অতিথি ও রেস্তোরাঁর আবহের একটা বিবরণ আছে। তাতে বলা হয়, প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত ছিল সেদিনের সন্ধ্যা। আর সব দিনের মতোই সবকিছু স্বাভাবিক চলছিল। হাসি-আনন্দে মুখর ছিলো হলি আর্টিজান বেকারির সন্ধ্যাবেলা। কিন্তু অতর্কিত জঙ্গি হামলায় পরিস্থিতি বদলে গেল রাত পৌনে নয়টার দিকে। হামলার স্থানে প্রথম পুলিশের ফোর্স পৌছায় ৮.৫০ মিনিটে । ফোর্সের দায়িত্বে থাকা রিপন কুমার দাস বলেন ‘আমি রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ফোর্সসহ হলি আর্টিজান এলাকায় যাই। গিয়ে দেখি আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চলছে। আমরা পাল্টা গুলি ছুড়ি।’ তিনি বলেন, ‘এ সময় জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণে ৩০-৩৫ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন পরে মারা যান।’

রুদ্ধশ্বাস রাত শেষে পরদিন ২ জুলাই, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেনা কমান্ডোরা অভিযান চালায়। অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গিসহ মোট ছয়জন নিহত হন। এরপর ঘটনাস্থলের দায়িত্বভার দেওয়া হয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে। তারা দীর্ঘদিন তদন্ত জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়।

এরপর শুরু হয় বিচারকার্য। জটিল এই বিচারকার্যে নানাভাবে প্রায় ১০৩ জনের স্বাক্ষ গ্রহণ করা হয় এবং গত ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে বিচারক রায় ঘোষণার জন্য ২৭ নভেম্বর নির্ধারণ করেন। এরই ভিত্তিতে আজ (২৭ নভেম্বর) দুপুরে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। ৭ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে এবং প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে আদালত। অভিযোগপত্রে নাম থাকা ২১ আসামির মধ্যে ১৩ জন মারা যাওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নিহত ১৩ জনের মধ্যে আট জন বিভিন্ন অভিযানে এবং পাঁচ জন ঘটনাস্থলে নিহত হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো : হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবির নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। আট আসামির মধ্যে নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড়ো মিজানকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায় পড়ার সময় সব আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

হামলার তিন বছর চার মাস ২৬ দিনের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন করা দেশের আইনের সুশাসনের প্রতিফলন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


শর্টলিংকঃ