রাস্তায় ছুটে চলা বৃক্ষ-বাহন


নিজস্ব প্রতিবেদক : 

প্রচণ্ড যানজট, হর্নের বিকট শব্দ। ঢাকা শহরে এমন যান্ত্রিক ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ করেই একটু প্রশান্তির ছোঁয়া। আর সেই ব্যস্ত শহরে একটি সিএনজি তার ছাদে লাল-সবুজসহ হরেক রংয়ের ফুল ও গাছ নিয়ে ছুটে চলছে। কৃত্রিম সবুজ ঘাস দিয়ে সিএনজিটি পুরো মুড়িয়ে রাখা। যানজট বা অন্যকোনকারণে সিএনজিটি থামলে চারপাশে উৎসুক জনতার ভিড় লেগে যাচ্ছে।

সিএনজি ঘিরে কেউ সেলফি তুলছেন, আবার কেউ বা মুঠোফোনে একটু ভিডিও করে রাখছেন। আর চারপাশ থেকে হাজার প্রশ্ন-এই গাছ তো মনে হয় প্লাস্টিকের। এইগুলান কি বাস্তব?

তবে ৩০ বছর বয়সী এ সিএনজি অটোরিকশার চালক জাহিদুল ইসলাম হাসিমুখেই সব প্রশ্নের উত্তর দেন। মাঝে মাঝে অতি উৎসাহী দর্শকদের থামাতে বলতে হয়-ভাই গাছে একটু আস্তে ধরেন।  এই অটোরিকশাটি রাতের বেলায় সবুজাভ আলো ছড়িয়ে যখন পথ চলে তখনো পেছনে মানুষের ভিড় একেবারে কম থাকে না।

জাহিদুল জানালেন, তাঁর আগে ঢাকা শহরে তপন ঘোষ নামে আরেক চালক এ রকম একটি অটোরিকশা রাস্তায় নামান। মূলত তাঁকে দেখেই উৎসাহী হয়েছেন। মালিক মো. তুহিনের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে অটোরিকশাটি সাজিয়েছেন।

শুধু গাছই আছে-এ প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া জাহিদুল বলতে শুরু করেন-টিস্যু, ফিল্টার পানি, পানি খাওয়ার জন্য একবার ব্যবহার করা যায় সে ধরনের গ্লাস, ছাতা, বড়ি স্প্রে, মশা মারার স্প্রে, গল্পের বই, ধর্মীয় বই, দৈনিক পত্রিকা, দুটি ফ্যান, ওয়াইফাইসহ আরও নানান কিছু আছে। গল্পের বই দেখতে চাইলে জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বের করে দেখালেন।

গাইবান্ধার এ যুবক গত প্রায় সাত থেকে আট বছর ধরে ঢাকায় অটোরিকশা চালান। আর অটোরিকশাকে মনের মতো করে সাজিয়েছেন গত দুই মাস আগে। অটোরিকশার ছাদ থেকে মরিচ বড় হলে তা খাবারে কাজে লাগে বলেই এক গাল হেসে বললেন-মরিচ কিন্তু হেব্বি ঝাল।

গাছ লাগানোর ফলে অটোরিকশার ওজন বেড়েছে, বৃষ্টির পানি যাতে না জমে থাকে তার জন্য বিশেষ পাইপ লাগাতে হয়েছে। তবে উপকারিতা সম্পর্কে জাহিদুল বলছিলেন-বাইরে খটখটে রোদ থাকলেও পর্দা দিয়ে ঘেরা অটোরিকশার ভেতরে তাপ কম লাগে। মাঝে মাঝে ভেতরে এসির বাতাসের মতন আরাম লাগে। আর যদি একটু গরম লাগেও দুই দুইটা ফ্যানতো আছেই।

সবুজ অটোরিকশার পাশে চালক জাহিদুল ইসলাম। অটোরিকশাটির মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি মনের মতো করে সাজিয়েছেন। ছবি: সাজিদ হোসেন

অটোরিকশাকে সাজাতে জাহিদুলের ৫০ হাজারের বেশি টাকা খরচ হয়েছে। আর প্রতি সপ্তাহে দৈনিক পত্রিকা কেনা, গাছের পরিচর্যা বা নতুন গাছ কেনা, স্প্রে কেনাসহ প্রায় এক হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয় বলে জানালেন। তবে অটোরিকশার মালিক খুশি হয়ে অন্য চালকদের চেয়ে দৈনিক ১০০ টাকা করে কম নেন বলেও জানালেন। জাহিদুল জানিয়ে দিলেন, এতে বসে কোনো যাত্রীকে ধূমপান করার অনুমতি দেওয়া হয় না। প্রশান্তির এ অটোরিকশা নিয়ে জাহিদুল বের হন সকাল ১০টার দিকে আর গ্যারেজে ফেরেন রাত ১১টায়। একা চালান বলে যত্ন নিতেও সুবিধা হয়। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ অনেক সময় আটকায়, তবে সব দেখে সুন্দর বলে আবার ছেড়েও দেয়।
জাহিদুল জানালেন, যাত্রীদের এতসব সুবিধা দিয়ে বাড়তি কোনো ভাড়া নেওয়া হয় না। তবে কোনো কোনো যাত্রী খুশি হয়ে কিছু বকশিশ দেন।

রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় জাহিদুলের অটোরিকশা গ্যারেজের ব্যবস্থাপক মো. মহসীন জানালেন, মালিকের ২৩টি অটোরিকশা। জাহিদুল অনেক দিন ধরেই একটিকে এভাবে সাজানোর কথা বলেছিলেন। পরে নতুন দেখে তাঁকে এটি দেওয়া হয়।

জাহিদুলের দুই ছেলে পড়ছে মাদ্রাসায়। এক মেয়ে ছোট। স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নিয়ে গাইবান্ধায় থাকেন।
যাত্রীদের এত সুবিধা দিয়ে আপনার লাভটা হচ্ছে কি-প্রশ্নের উত্তরে জাহিদুল বলেন, ‘লাভ-লসের কথা চিন্তা কইরা করি নাই। সবাই সুন্দর বলে তাতেই আমি খুশি।’


শর্টলিংকঃ